ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস
ঝিনাইদহের চোখঃ
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস—মাঝখানে কয়েকবার আপনার ক্যারিয়ারের বাঁক বদলেছে। সংক্ষেপে যদি একটু বলেন…
আমার আব্বা ছিলেন শিক্ষক। ছোটবেলায় আব্বার অনুশাসন এত কড়া ছিল যে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে বরং মনে হয়েছিল, একটু স্বাধীনতা পেলাম। পড়ালেখায় ছোটবেলা থেকেই ভালো ছিলাম। ম্যাট্রিক (এসএসসি), ইন্টারমিডিয়েটে (এইচএসসি) স্ট্যান্ড ছিল। খেলাধুলা আমাকে খুব টানত। সব কটি ক্যাডেট কলেজের মধ্যে সেরা ফুটবলার হয়েছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের পর চান্স পেয়ে গেলাম ওয়ারী ফুটবল দলে। খেলোয়াড় হিসেবেও যে ক্যারিয়ার গড়া যায়, সেটা তখন কেউ বিশ্বাস করত না। তা না হলে আমি ফুটবলারই হতাম। আব্বা চাইতেন, আমি যেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। আমারও ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে জেনারেল হব। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পর মনে হলো, বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করব। আবেদন করলাম। কাগজপত্র আসতে একটু সময় লাগছিল। আব্বা অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন। তখন যোগ দিলাম সেনাবাহিনীতে। সেখানে খুব ভালোই করছিলাম। কিন্তু চার মাস পর যখন বিদেশি ইউনিভার্সিটি থেকে কাগজপত্র চলে এল, তখন আবার মত বদলে ফেললাম। সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে এলাম ঢাকায়। আমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই তখন সেনাবাহিনীতে ছিল, তারা খুব খেপে গেল। আমার এখনো মনে আছে, একজন বলেছিল, ‘ও হবে একটা রটেন র্যাট (পচা ইঁদুর)।’
তত দিনে তো বোধ হয় আপনার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা অনেকটা এগিয়ে গেছে।
হ্যাঁ। ঢাকায় এসে দেখি, বন্ধুদের কেউ বুয়েটে, কেউ মেডিকেলে পড়ছে। কী দারুণ লাইফ এখানে! এদিকে ভিসার কাগজপত্র আসতে দেরি হচ্ছিল, এক সেমিস্টার মিস হয়ে গেল। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে, বিদেশে আর গেলাম না। দেখেন, ১৯ বছরের একটা ছেলে জীবনে কত বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আমার সবচেয়ে সৌভাগ্য, আমি যা করতে চেয়েছি, মা-বাবা কখনো বাধা দেননি। আমার বাবা আমাকে শাসন করেছেন ক্যাডেট কলেজে পড়ার আগ পর্যন্ত। এরপর কোনো দিন কোনো কিছু চাপিয়ে দেননি। যা হোক, সেনাবাহিনী ছেড়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছি। মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি, ব্রাসেলসে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ব। ভিসাও হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম। যাইনি। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে স্নাতক করেছি সামাজিক বিজ্ঞানে। এরপর আইবিএ থেকে এমবিএ করে চলে গেছি ফিনল্যান্ড, হেলসিঙ্কি স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে পড়েছি। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছি।
দেশে ফিরে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যবসাও করেছেন। ‘এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’ বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন বলেই কি উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি ঝোঁক ছিল? নাকি নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন বলে?
দুটাই। যেহেতু চিংড়ির দেশের লোক আমি, আইবিএর শিক্ষক থাকা অবস্থাতেই চিংড়ির ঘের করা শুরু করেছিলাম। সুন্দরবন সায়েন্টিফিক শ্রিম্প কালচার লিমিটেড—আমার প্রথম প্রকল্প। বৃহস্পতিবার বাসে করে খুলনা চলে যেতাম, শনিবার ফিরতাম। বাসে বসেই ক্লাসের প্রস্তুতি নিতাম। ভোরবেলা ঢাকায় নেমে, গোসল করে ক্লাসে চলে যেতাম। পরিশ্রমকে আমি কখনো ভয় পাইনি। ফিনল্যান্ডে আমার কিছু বন্ধু ছিল, বড় বড় পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিক। থাইল্যান্ড, হংকং থেকে ওরা পোশাক নিত। যখন বাংলাদেশ থেকেও পোশাক নিতে চাইল, আমি ওদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সকালে ক্লাস নিয়ে সন্ধ্যাবেলা চলে যেতাম একেকটা কারখানায়। প্রচুর পরিশ্রম করেছি। দুই বছরের মধ্যে আমার প্রায় এক-দেড় কোটি টাকা আয় হলো। সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন, যে পরিবর্তন আনতে চায়, তাকে প্রচণ্ড সাহসী হতে হয়।
দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেক তরুণের সঙ্গে আপনার নিয়মিত দেখা হয়, কথা হয়। আপনার মধ্যে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার যে সাহস ছিল, সেটা কি এই তরুণদের মধ্যে দেখতে পান?
এখনকার তরুণদের ইতিবাচক দিক হলো এদের ভাবনার জায়গাটা খুব পরিষ্কার। জটিলভাবে চিন্তা করে না। ওদের শক্তি আছে, সাহস আছে। সে জন্যই কিন্তু তরুণেরা আমাদের ভবিষ্যৎ। রাষ্ট্রের কাছে আমার অনুরোধ, এই তরুণদের কাজে লাগাতে হলে আমরা যেন শিক্ষা খাতটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই।
ব্যবসা কি আপনি উপভোগ করেন?
নিশ্চয়ই। আমার ব্যবসা কিন্তু আমি আইবিএর ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই শুরু করেছি। কারণ, সৃজনশীল কিছু করতে ভালো লাগে, চ্যালেঞ্জটাও খুব মজার। ক্রিকেটে শেষ বলে ছয় মেরে দলকে জেতানোর যে আনন্দ, ফুটবলে শেষ মিনিটে গোল করে জয় ছিনিয়ে আনার যে রোমাঞ্চ, নতুন একটা উদ্ভাবন, একটা উদ্যোগের মধ্য দিয়েই সেই আনন্দ পাওয়া যায়। ছোটবেলায় বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সত্যি বলতে, ব্যবসাকে খুব বড় চোখে দেখতাম না। কিন্তু ভেবে দেখুন, একজন বিজ্ঞানী ল্যাবে বসে যেই আবিষ্কার করছেন, ব্যবসায়ীরাই তো তাঁর উপকারটা সমাজের মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। প্রথম কম্পিউটারটা ছিল একটা রুমের সমান বড়।
আজকে আমাদের হাতে হাতে কম্পিউটার পৌঁছে দিল কারা? ব্যবসায়ীরা। নতুন নতুন ব্যবসাই একটা সমাজকে এগিয়ে নেয়।