দেখা-অদেখা

লালন শাহর মাজার

ঝিনাইদহের চোখঃ

মোটামুটিভাবে ১৭ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাউল মতের উন্মেষ ঘটলেও এই মত ও পথকে জনপ্রিয় করে তোলেন বাউল সম্রাট মরমি সাধক গুরু লালন ফকির। বাউল সম্রাট লালন ফকিরই বাউল ধারণার একটি স্বতন্ত্র ধর্ম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

লালন ছিলেন হিন্দু ধর্মালম্বী। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি শ্রীক্ষেত্রে যাত্রা শুরু করেন। ফেরার পথে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে পথের মাঝে ফেলে রেখে যায় এবং তার মৃত্যু সংবাদ রটিয়ে দেয়। সিরাজ শাহ নামক এক নিঃসন্তান পালকিবাহক পথ থেকে লালনকে তুলে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলে। সুস্থ হয়ে লালন বাড়ি ফিরে গেলে মুসলমানের ভাত খেয়েছে বলে তাকে ঘরে উঠতে দেয়া হয় না। তার বউও জাতিচ্যুত স্বামীকে অস্বীকার করে। উপায়ান্তর না দেখে লালন তার আশ্রয়দাতা সিরাজ শাহর কাছে ফিরে আসে এবং তাকে গুরু পদে বরণ করে নেয়। ১৮২৩ সালের দিকে লালন নানা তীর্থ ভ্রমণ শেষে কুষ্টিয়া কুমারখালীর সেওড়িয়া গাঁয়ে এক মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করে এবং এখানেই আখড়া গড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৮৯০ সালে লালনের মৃত্যুর পর এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। যা বর্তমানে লালন শাহর মাজার নামে ব্যাপক পরিচিত।

গন্তব্য লালন শাহর মাজারকে সামনে রেখে যখন গাবতলী টার্মিনালে এসে বাসে চড়ি, তখন ঘড়ির কাঁটায় ৩টা বেজে ৫ মিনিট। বাস ছাড়ার পর একটা প্রস্বস্তি আসে, যাক রওনা তো হলাম। বাসে চড়ে মনে মনে ভাবতে থাকি কুষ্টিয়া নেমে প্রথমে হোটেল, তারপর বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া, তারপর ঘুম। পরদিন সকালে সোজা সাঁইজীর মাজারে। এরপর… লালন শাহর মাজার বলে কথা। তার মাজার প্রাঙ্গণে যাওয়ার আগেই মনে মনে বেজে উঠল লালনের গান। তারপর তো একের পর এক গলা ছেড়ে না গেয়ে থাকতে পারলাম না। গেয়েই চললাম কিছুক্ষণ পর সাভার পৌঁছলে একটু যানজট কোলাহল মাঝে এসে আবার সেই ব্যস্তচিত্র। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল লালনের গান। যানজট মুক্ত হয়ে আরেকটু এগুতেই জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফলক চোখে পড়ল।

মানিকগঞ্জ শহর পেরিয়ে তুলনামূলক রাস্তা একটু ফাঁকা থাকার কারণে বাস গতিপ্রাপ্ত হয়। এ সময় বাসের জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস এসে গায়ে লাগতেই দু’চোখ বুজে যায়। চোখ খুলতেই পাটুরিয়া ঘাটে রয়েছি। কন্ডাক্টর সাহেব বললেন, ১০ মিনিট লাগবে, আরেকজন যাত্রী বললেন, আরও ১৫ মিনিট। তারপর ফেরি চলতে লাগল পদ্মার মাঝখান দিয়ে। বাস থেকে নেমে ফেরির তিনতলার দর্শক কেবিনে চলে গেলাম। তৃতীয় তলার উপরে বসে সর্বনাশা পদ্মাকে বেশ ভালো লাগছে। পড়ন্ত বেলার সূর্য ডুবে যাওয়ার সে এক অপূর্ব মুহূর্ত। কুষ্টিয়া এসে একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেল ম্যানেজারের ব্যবহার খুব ভালো লাগল। রিপোর্টার বলে আপ্যায়নও করলেন এক কাপ চা বাড়িয়ে। রাতটা কোন মতে পার করে সকালের নাস্তা শেষ করেই রিকশাযোগে সোজা সাঁইজীর মাজার। মাজার গেটের সামনে নেমেই ডানপাশে ছোট্ট একটা বাজার লক্ষ্য করলাম। প্রায় সব দোকানেই একতারা, দোতারা, লোকজ বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। ভাবছিলাম আগে কিছু কিনব কিনা। শেষে ঠিক করলাম আগে গুরুর মাজার তারপর কেনাকাটা।

গেট দিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই আপনা-আপনিই একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছিল নিজের মধ্যে। চারদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বেশ গোছালো। সামনে মাজার যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে মরমী সাধক গুরু লালন সাঁইজী। আরও কিছু সমাধী। বেশকিছু লালনভক্ত চেখে পড়ল। দর্শনার্থীদের কাছ থেকে যে বকশিস পায় তা দিয়েই তাদের চলে।

যেখানে চলে এই বিনোদন জানতে পারলাম এটা অডিটোরিয়ামের নিচতলা। উপরতলায় অডিটোরিয়ামের মূল কক্ষ। এখানে মাঝে মাঝেই নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অডিটোরিয়ামটা বেশ উন্নত। পাশে একটা পাঠাগার ও জাদুঘর রয়েছে। জাদুঘরে বেশকিছু লোকজ সংগ্রহশালার নিদর্শনসহ রয়েছে লালন ফকিরের ব্যবহƒত একটি একতারা। সাশ্রয় মূল্যের হস্তশিল্প সামগ্রীও কেনাকাটার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button