সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ
সদা হাস্যোজ্জ্বল আদর্শ কৃষক হেলাল উদ্দীন। বয়স ৭২ পেরিয়ে গেছে। সমাজ উন্নয়ন, মাটি, পানি, বায়ু সুস্থ রাখতে এবং বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সারাজীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। নিজ এলাকার কারও মৃত্যু অথবা সদ্যজাত শিশুর জন্ম গ্রহনের খবর পেলেই তারিখ এবং সময় নিজ ডাইয়েরীতে লিখে রাখেন। কোন স্থান থেকে কৃষি খবরের প্রতিবেদনের পত্রিকা হাতে পেলেই পকেটে ভরে নিয়ে চলে যান বাড়িতে। প্রেসক্লাবে দেয়া প্রয়োজনীয় পত্রিকা হারিয়ে গেলে সাংবাদিকেরা আগে জানার চেষ্টা করেন হেলাল নানা এসেছিলেন কিনা। আসার ব্যাপারটা নিশ্চিত হলে সাংবাদিকেরা এক প্রকারে বুঝেই নেন পত্রিকাটি হয়তোবা হেলাল নানার কাছেই আছে।
কেননা অনেক সংবাদকর্মি হারানো প্রয়োজনীয় পত্রিকাটি সংরক্ষিত অবস্থায় পেয়েছেন তার বাড়িতে। তিনি জৈব সার উৎপাদনে নিজ জেলাসহ দেশের কমপক্ষে ১৫ টি জেলার কয়েক হাজার কৃষকদের প্রশিক্ষন দিয়েছেন। কৃষিতে অবদানের জন্যই তিনি ইতোমধ্যে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার। বয়োবৃদ্ধ হেলাল উদ্দীনের বাড়ি ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মহেশ্বরচাঁদা গ্রামে।
কৃষক হেলাল উদ্দীনের স্ত্রী মাহিরুন্নেসা জানান, বিয়ের পর গল্প শুনেছেন গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ায় বাল্যকালে হেলাল উদ্দীনের না খেয়েও দিন কেটেছে। বড় ভাই দেলবার আলী আর খেলাফত আলীকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখেছেন হেলাল উদ্দীন। সে সময়ে ২য় শ্রেণীর পর আর লেখাপাড়া করতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে জীবনভর পরিশ্রম করে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে সংসারের গতি ফিরিয়ে অভাব তাড়িয়েছেন। ১ মেয়ে ও ৩ ছেলে তাদের। সকলকেই বিয়ে দিয়েছেন। এখন তাদের সুখের সংসার।
বৃদ্ধা মাহিরন আরও বলেন,হেলাল উদ্দীন একজন সহজ সরল মানুষ। সারাজীবন সমাজ উন্নয়ন ও পরিবেশ বিশুদ্ধকরণ, আধুনিক কৃষি ছাড়াও মানব কল্যানে নিরাপদ খাদ্যোৎপাদনের জন্য নিজে কাজ করেন। আবার অন্যদেরকে উৎসাহিত করেন।
সরেজমিনে হেলাল উদ্দীনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়,তার সারা বাড়ি জুড়েই রয়েছে জৈব সার উৎপাদনের বড় খামারসহ নানা সরঞ্জামাদি। দেখা যায়, তার ঘরের ছাদ থেকে শুরু করে বাড়ির আনাচে কানাচে নানা জাতের ঔষধী বৃক্ষে ভরা।
গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক রেজাউল ইসলাম জানান, ছোটবেলা থেকেই দেখছেন হেলাল অন্যদের চেয়ে খানিকটা ভিন্ন। তার কর্মকান্ডের জন্য সকলের কাছেই প্রিয় একজন মানুষ। কেননা কারও বিপদের খবর শুনলেই তিনি ছুটে যান। গ্রামের মাঝে যেখানে স্বল্প পরিসরে হলেও বাজার বসে এ হাটখোলাটি বিগত ২৫ বছর ধরে প্রতিদিন ভোরে হেলাল উদ্দীন ঝাড়– দিয়ে পরিস্কার করেন। এ কাজে তার কোন স্বার্থ নেই। এছাড়াও কৃষি খবরের পত্রিকা সংগ্রহ, রাস্তার পাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানোসহ বিভিন্ন ধরনের সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করেন।
গ্রামের কৃষকদেরকে রাসায়নিক সার বাদে জমিতে জৈব সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেন। নিজ এলাকার কৃষকদেরকে কেঁচো সার তৈরীর ফ্রি প্রশিক্ষণ দেন। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কোন কৃষক পরিবার থেকে তাকে ককনও দাওয়াত দেয়া হলে সেখানে মিষ্টির পরিবর্তে নিজ ফার্মের কেঁচো পাত্রে ভরে নিয়ে যান। সাথে সাথে তাদেরকে কেঁচো পালন ও এ দিয়ে কোঁচো কম্পোষ্ট সার তৈরীর কলা কৌশল শিখিয়ে দিয়ে আসেন।
হেলাল উদ্দিন জানান, পৃথিবীতে কোন কাজই ছোট নয়। সমাজের একজন ক্ষুদ্র মানুষ হয়ে মানুষের উপকারে আমি চেষ্টা করি। জনপ্রতিনিধি, সংবাদকর্মীসহ উপজেলার বেশিরভাগ স্থানেই আমি নানা হিসেবে পরিচিত। সেই সুবাদে সকলেই ভালোবাসেন। ফলে আমি একজন সুখী মানুষ। কিন্তু আমার একটি অভ্যাস আছে পুরানো অথবা নতুন যাই হোক কৃষি নিয়ে লেখা ভাল কোন প্রতিবেদন চোখে পড়লেই কখনও চেয়ে আবার কখনও কাউকে না বলেই পকেটে ভরে নিয়ে চলে আসি। আবার মাঝে মধ্যে টাকা দিয়েও কিনি। উদ্দেশ্য একটিই,পেপারে গুরুত্বপুর্ণ কিছু থাকলে সেগুলো নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা। আর এখানকার সাংবাদিকদের নিজস্ব কপি হলে কারও কাছে না শুনেই পকেটে ভরি। তারা ভালোবাসার খাতিরে আমাকে কিছু বলেন না।
কিন্ত তাদের প্রয়োজন হলে সেটা আবার ফেরত দিই। এমন ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। ৭২ বছর বয়সী হেলাল উদ্দিন আরও জানান, গত ২৫ বছর ধরে তিনি নতুন পুরাতন পেপার সংগ্রহ আর ৫০ টি ডায়েরী লেখার কাজ শেষ করেছেন। আর বাড়িতে জমা হয়েছে কয়েক মন পুরাতন পত্রিকা। তিনি জানান, সারাদিনের কাজ শেষ করে রাতে আমার কাজ ডায়েরি লেখা।
হেলাল উদ্দিনের ছেলে শাহিন হোসেন জানান, আমি জন্মের পর থেকেই দেখছি বাবা রাত জেগে ডায়েরী লেখেন। পরিবারের সকলের আপত্তি থাকলেও কোন কর্ণপাত করেন না। এলাকার সকল দুঃসংবাদ,সুসংবাদ সবই তিনি তার ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করেন।
নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ রনি লস্কর জানান,হেলাল উদ্দিন একজন আদর্শ কৃষক। তিনি জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। উপজেলার অনেক কৃষক কৃষাণীকে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও খরচ সাশ্রয়ে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যে তিনি জাতীয় কৃষিপদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন।
হেলাল উদ্দিন যেন একজন জীবন্ত তথ্য ভান্ডার। নিজের মতো করে তিনি এই ডায়েরীগুলো লিখে যাচ্ছেন। হেলাল উদ্দিন এখনো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। আবার সবার আগে ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে পড়েন
কালীগঞ্জের সাংবাদিক শাহাজান আলী বিপাশ ও তারেক মাহামুদ জানান, হেলাল উদ্দিন একজন সাদা মনের মানুষ। সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলেন। তার সাথে কখনও অপরিচিত কেউ কথা বললে তাকে ভাবতে হবে সে যেন কতদিনের চেনামূখ। এই দুই কলম সৈনিক আরও বলেন, হেলাল উদ্দীনের করা বিভিন্ন কাজ নিয়ে সাংবাদিকেরা তার নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। সে কারনেই সাংবাদিকদের সাথে তার সম্পর্কটা অত্যন্ত গভীর।
কালীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি জামির হোসেন জানান, প্রায় দিন বিকালেই হেলাল নানা প্রেসক্লাবে আসেন। কৃষি সংক্রান্ত অথবা সমাজ উন্নয়নের কোন ভাল নিউজ দেখলেই কারও সাথে কিছু না বলেই পত্রিকাটি পকেটে ভরে নিয়ে চলে যান। এটা প্রথম দিকে সাংবাদিকেরা বিরক্তিবোধ করতেন। কিন্ত যখন দেখলেন মানুষের কল্যানে কাজ করছেন হেলাল। তখন থেকে সকলেই তাকে সমীহ করেন। এই মিডিয়াকমি আরও জানান, প্রেসক্লাব থেকে কাউকে না বলে পত্রিকা বাড়িতে নিয়ে গেলেও তা হেলালের নানার বাড়িতে থাকে সযতনে সংরক্ষিত।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, হেলাল উদ্দীন একজন আদর্শ কৃষক। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের আন্দোলনে তিনি জীবনভর যুদ্ধ করছেন। কৃষিতে অবদানের জন্য ইতোমধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পেয়ে সকলকে গর্বিত করেছেন।