সাক্ষাৎকার

গড়াই বাঁচলে আশপাশের নদী, জেলা বাঁচবে: ড. আনোয়ারুল করীম

ঝিনাইদহের চোখঃ

নর্দান ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি ড. আনোয়ারুল করীম। লালন ও রবীন্দ্র গবেষণার পাশাপাশি ফোকলোরের সঙ্গেও সক্রিয়। কাজ করছেন গড়াই এরিয়া ওয়াটার পার্টনারশিপ নিয়ে। গড়াই নদীর দুঃখ-শোক নিয়ে মাঠে আছেন দুই দশক। বিপন্ন নদী, বিপন্ন পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে তিনি উচ্চকণ্ঠ। গড়াই বাঁচাতে কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে।

আপনার প্রিয় গড়াই কেমন আছে?
সত্যিই আমাকেও মাইকেল মধূসূদন দত্তের মতোই সব সময় গড়াই আগলে রাখে। যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি গড়াই আমার চিন্তা-চেতনা ও মনন থেকে সরে না। মাইকেলের কপোতাক্ষ সময়ের বিবর্তনে মৃত্যু পথযাত্রী, আমার গড়াইও ভালো নেই। এক সময়ের যৌবনাবতী নদী আজ শীর্ণকায়, তার বুকে ধু-ধু বালুচর। শেষ চৈত্রের দিকে আগে গড়াই টইটুম্বর হয়ে থাকত। মাঝি-জেলেদের সে কি ব্যস্ততা। কয়েকদিন আগে ঘুরে এলাম, যতদূর চোখ যায় বালু আর বালু। চোখ ভিজে আসে, আমাদের কিশোর সময়টাতে কি দেখেছি আর আজ সেখানে…

এমন হলো কেন?
মূলত, ১৯৭৫ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকেই গড়াইয়ের কপালে দুঃখ নেমে আসে। প্রথম দিকে পরীক্ষামূলকভাবে যখন ফারাক্কা চালু হলো তখনো পানির হিস্যা মোটামুটি ঠিক ছিল। পরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে ভারত একতরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। সহজ করে বলতে গেলে, বর্ষার সময় যখন পানির চাপ বাড়ে তখন ভারত ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেয়। অতিরিক্ত পানির চাপে তখন আমাদের দেশেও বন্যা দেখা দেয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির চাহিদা বাড়ে তখন তারা বাঁধ আটকে রাখে, ফলে গড়াই শুকিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৪ জেলার ওপর। পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে গড়াইয়ের উৎসমুখে পলি জমে। একসময় দেখা যায়, পদ্মা থেকে গড়াই প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের এ ধারাবাহিকতায় গড়াইয়ের এ বেহালদশা।

বিরূপ প্রভাবে…
গড়াইয়ের পানি প্রবাহের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৪ জেলার মানুষের ভালো-মন্দ। আমি মনে করি, তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় গড়াইয়ের ওপর। একটু বলে রাখা দরকার, ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে সেচ সুবিধা ও বন্যা থেকে ফসল ও জনপদ রক্ষার জন্য গঙ্গা কপোতাক্ষ পরিকল্পনা (জিকে) সেচ প্রকল্প নামে কার্যক্রম চালু হয়। জাতিসংঘের সহযোগিতায় চালু হওয়া সে প্রকল্পের আওতায় ফসল উৎপাদন বেড়ে যায় প্রায় তিনগুণ। এ প্রকল্পের মূল উৎস ছিল গড়াই। গড়াই নাব্য সংকটে থাকায় উৎসমুখের কাছে ভেড়ামারাতে পাম্প হাউস স্থাপন করে এ প্রকল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, তাও রক্ষা হয়নি। যা বলছিলাম, গড়াই শুকিয়ে যাওয়ার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকে। এখন তো নিশ্চিত মরূকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এ জেলাগুলো। সব থেকে বড় কথা, গড়াইয়ের সঙ্গে ধ্বংস হতে শুরু করেছে সুন্দরবনও।

সুন্দরবনের সঙ্গে গড়াইয়ের সম্পর্ক কী?
বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। একদিকে মনুষ্য সৃষ্ট বাঁধের কারণে গড়াইসহ নদীগুলোর পানি কমছে অন্যদিকে প্রকৃতি থেকে সমুদ্রের পানি ফুলেফেঁপে তেড়ে আসছে। ফলে সমুদ্রের নোনা পানি ঢুকে পড়ছে নদীগুলোতে। ফলে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যসহ সব ক্ষেত্রে লবণাক্ততা বেড়ে ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরবনে সুপেয় পানি বা মিঠা পানির প্রবাহ না থাকার ফলে সেখানে ভয়াবহ সংকটে পড়ছে প্রাণীকুল।

গড়াইয়ের পানি সুন্দরবনে কীভাবে যাবে?
আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক নদীর মূল উৎস পদ্মা। কুষ্টিয়া শহর থেকে ছয় কিমি উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গা এ অঞ্চলে পদ্মা-গড়াই নামে পরিচিত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মিঠা পানির একমাত্র উৎস এই নদী। কুষ্টিয়া জেলায় ৩১ কিমি এলাকাজুড়ে গড়াই নাম ধারণ করে আছে, কিন্তু পথপরিক্রমায় এই নদীর নাম বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন হয়েছে। কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ ঢোকার পরে সেখানে নাম হয়েছে কালিগঙ্গা ও নবগঙ্গা। এর পর ফরিদপুর এলাকায় মধুমতি, মাদারীপুর ও বরিশাল পর্যন্ত আড়িয়াল খাঁ, অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল, মাগুরা জেলাজুড়ে ভৈরব নদী। ভৈরব-কপোতাক্ষ নদসহ অনেক প্রবাহের মাধ্যমে গড়াইয়ের পানি সুন্দরবনে যায়। সুন্দরবনের প্রাণীকুলসহ জীববৈচিত্র্যে রক্ষার অন্যতম সহায়ক এই মিঠা পানি। সেখানে সমুদ্রের নোনা পানি উঠে আসার ফলে হুমকির মুখে রয়েছে তার অস্তিত্ব। মোট কথা, এ অঞ্চলে মিঠা পানির শুরুটা গড়াই থেকে। উৎস শুকিয়ে গেলে অন্যগুলো কেউ বেঁচে থাকে না। বাস্তব অবস্থাও এখন তাই। এই অঞ্চলের নদীগুলো সরু ক্যানেল থেকে এখন ভরাটও হয়ে গেছে অনেক। অনেক জায়গায় দখল ও দূষণে নদীর অস্তিত্বও হারিয়ে গেছে। সেসব জায়গায় একসময় প্রবহমান নদী ছিল তা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে।

গড়াই বাঁচাতে পুনঃখনন প্রকল্প কতটা সুফল আনছে?
গড়াইয়ের নাব্য ফিরিয়ে আনা ও দক্ষিণাঞ্চলের পানির লবণাক্ততা কমিয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার মিশন নিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে গড়াই নদী খনন কাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে জিআরসি প্রকল্পের মাধ্যমে ড্রেজিং শুরু হয়। ওই খননের সুবিধা এক বছর পেলেও পরের বছর দ্বিগুণ ক্ষতি হয়। খননকৃত বালু পাড় থেকে পানিতে নেমে নদী মরা খালে পরিণত হয়। ২০১০-১১ থেকে গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প-২ নামে আবারও খনন শুরু হয়। এই খননের মূল লক্ষ্য গড়াই নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা, এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা, সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা দূরীকরণসহ কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর ও খুলনা এলাকাকে মরূকরণের হাত থেকে রক্ষা করা। প্রায় হাজার কোটি ব্যয়ে প্রকল্প শেষে দেখা গেল অবস্থা আগে ছিল তাই-ই রয়ে গেছে। গড়াই নদী খননের তৃতীয় প্রকল্পও মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আসলে রোগ যেখানে সেখানে ওষুধ না দিলে যা হয় গড়াইয়ের কাহিনী এখন অনেকটা ওই রকম। মূল সমস্যা হচ্ছে, গড়াইয়ের উৎসমুখ। ফারাক্কা বাঁধের ফলে পদ্মায় বা গড়াইয়ের উৎসমুখে পানি না থাকায় এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে।

নদীর গতি-প্রকৃতি ও চরিত্র…
মূল নদীগুলোর প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন ধরন বা গতি-প্রকৃতি ও চরিত্র থাকে। মিঠা পানির এই বৃহৎ নদীর সঙ্গে নোনা পানির নদীর আচরণ এক হবে না। আবার যেসব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় তাদের সঙ্গে এর মিল থাকবে না। আমি বলতে চাইছি, গড়াইয়ের পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হলে তার খনন কাজ পরিকল্পিতভাবে করা দরকার। নদীর বালু আবার যদি ঘুরে খননকৃত টানেলের মধ্যেই ফিরে আসে তাহলে তা অর্থহীন। আবার যেটুকু গভীরতায় কাটা দরকার তা ঠিক রাখতে হবে। বছরের পর বছর খনন চলল কিন্তু নদীতে কোনো প্রবাহ থাকল না, মানুষ সে খননের কোনো সুবিধা পেল না তা টিকবে না। অনেক ভালো ভালো কথা বলে খনন কাজ শুরু করে কিন্তু বাস্তবে তার কোনো মিল পাওয়া যায় না। এখন গড়াইয়ের মূল সমস্যা দেখা দিয়েছে এর ওপর অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ নিয়ে।

ব্রিজগুলো অপরিকল্পিত কীভাবে?
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর বিকল্প নেই। বর্ধিঞ্চু অর্থনীতির চাপে আবারও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে নজর দেওয়ার সময় রাষ্ট্রের থাকে না। অনেক সময় মানুষের যোগাযোগ ও নগরায়নের ফলে নদীকে বেছে নিয়েছে। সেখানে দ্রুত সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্রিজ নির্মাণ, কখনো দখল আবার কখনো দূষণও করা হচ্ছে। গড়াই নদীর ১২ কিমির মধ্যে এখন রয়েছে পাঁচটি ব্রিজ। উৎসমুখের কাছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এই ব্রিজটি রেল যাতায়াতের জন্য ব্রিটিশরা করেছিল। পরে তার পাশেই করা হয়েছে গাড়ি চলাচলের জন্য লালনশাহ সড়ক সেতু। কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে হরিপুরের সংযোগ স্থাপনে সম্প্রতি সেখানে করা হয়েছে একটি সড়ক সেতু। কুমারখালীর সঙ্গে কুষ্টিয়ার সংযোগে আগে সেখানে রেলসেতু ছিল, পাশেই সড়ক সেতু স্থাপন করা হয়েছে। নতুন নির্মিত সেতুগুলো অধিকাংশই অপরিকল্পিত। নদীর মাঝে ব্রিজের বিশাল বিশাল পিলার থাকার কারণে তার চারপাশে পলি ও বালু জমছে। ফলে এক ধরনের বাঁধের তৈরি হচ্ছে। বলা যায়, উপরে ব্রিজ আর নদীর বুকে বাঁধ। এর ফলে গড়াই দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই এত প্রতিকূল অবস্থাতে একট নদী বেঁচে থাকতে পারে না। এখন এই ব্রিজগুলো গড়াইয়ের দুঃখ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

কিন্তু ব্রিজগুলোও তো দরকার, তাহলে?
ব্রিজের প্রয়োজন তো আমি অস্বীকার করছি না। কুমারখালীর সংযোগে রেলসেতুর পাশে যখন সড়ক সেতু নির্মাণ শুরু হলো, সে সময় আমরা প্রকৌশলীদের সঙ্গে বসেছিলাম। নদীর মাঝে পিলার দিলে কি সমস্যা হবে তা বুঝিয়ে বললাম। ওই ব্রিজের যেসব প্রকৌশলী ছিলেন তারা ভালোভাবে শুনে-বুঝে ঠিক করলেন নদীর মাঝে পিলার কমিয়ে দিবেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা ওই ব্রিজটির পিলার কমিয়ে নদীকে কিছুটা রেহাই দিলেন। তবে যেসব মন্ত্রণালয় বা সরকারের যেসব বিভাগ থেকে এই ব্রিজগুলো করা হয় অনেক সময় সেখানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের অভাব দেখা যায়। আবার অনেক জায়গায় রাজনীতিবিদদের অগ্রাধিকার প্রকল্পে আওতায় অথবা প্রতিশ্রুতি পালনে এসব ব্রিজ নির্মাণের ফলে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সময় পাওয়া যায়। আমি চাই-ব্রিজ হোক, কিন্তু সেগুলোকে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে ফেলে এমনভাবে তৈরি করা যাবে না। বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে ঝুলন্ত ব্রিজ আছে, কলকাতার হাওড়া ব্রিজের মতো সম্ভব না হলেও নদী বাঁচিয়ে কাছাকাছি অনেক প্রযুক্তি আছে যেগুলো ব্যবহার করে নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করা সম্ভব।

ব্রিজ নিয়ে এখন কী করার আছে?
নদী যেখানে ভরাট হয়ে মারা যাচ্ছে সেখানে সবার আগে নদীকে বাঁচানো জরুরি। ব্রিজের কারণে যদি নদী বাঁচানো না যায় তাহলে তো আর ব্রিজের দরকার নেই। শুষ্ক মৌসুমে যেভাবে গড়াইয়ের বুকে হেঁটেই মানুষ পার হতে পারে, একসময় বর্ষার মৌসুমেও তা পারবে। যা হোক, যে ব্রিজগুলো অপরিকল্পিতভাবে হয়েছে তা অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত প্রকৌশল গবেষণা থেকে পিলার কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রিজের মাঝের পিলার কমিয়ে গড়াই বাঁচাতে হবে।

গড়াই বাঁচাতে জরুরি কী?
সবার আগে উৎসমুখে পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য দরকার ফারাক্কা চুক্তির সফল বাস্তবায়ন। না হলে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেকটা কাজের একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, বাংলাদেশের যে প্রধান নদী পদ্মা তার উৎস কিন্তু ভারতে। তারা বাঁধ দিয়ে পদ্মার পানি নিয়ন্ত্রণ করছে, আমরা পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছি না বলে আমাদের গড়াইসহ নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। খনন বলেন আর যাই বলেন না কেন সবার আগে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হলে ফারাক্কার পানির হিস্যা বুঝে নিতে হবে অথবা গঙ্গা বাঁধ তৈরি করতে হবে।

কিন্তু গঙ্গা বাঁধ কতটা সুফল বয়ে আনবে?
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, ’৬০-এর দশকে যখন ফারাক্কা নির্মাণ শুরু হয় তারও আগে ১৯৫৪ সালে জিকে সেচ প্রকল্পের জন্য ভেড়ামারাতে দুজন বিদেশি প্রকৌশলী এসেছিলেন। তাদের একজন আলোচনাকালে বলেছিলেন, এক দিন এ দেশের মানুষের বউদের গহনা বিক্রি করে হলেও অ্যান্টি-ফারাক্কা তৈরি করতে হবে। না হলে এ দেশ বন্যায় ডুববে আবার পানির জন্য হাহাকার করবে। হ্যাঁ, গবেষণার পাশাপাশি আমরাও দেখেছি, গঙ্গা বাঁধ তৈরি হলে বর্ষার সময় এখানেও সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষও সোচ্চার। তারাও আমাদের মতো বর্ষার সময় ডুবে যাচ্ছে আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে হাহাকার করছে। গঙ্গা বাঁধ একটা সিগন্যাল, এটি নির্মাণ হলে তখন ভারত পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য থাকবে। এখন যেমন তারা কোনো কথায়ই কানে তুলছে না তখন শুনতে ও আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে।

আইনের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের উপায় নেই?
বিষয়টি নিয়ে বহুবার, নানাভাবে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ভারত ও নেপালকে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিদেশীয় বৈঠকের কথাও হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদীর গতিপথ রোধ বা বাঁধ দেওয়ার কোনো আইন না থাকলেও তা মানেনি ভারত। জাতিসংঘের মাধ্যমে আমাদের সমস্যাটা জোরালোভাবে এখন তুলে ধরা জরুরি। ভারত যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতিম দেশ, তাদের কাছে আমরা সহযোগিতা আশা করি। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, আজ আমরা যে সমস্যা মোকাবেলা করছি কিছু দিনের মধ্যেই সে সমস্যায় ভারতকেও ভুগতে হবে। সে কারণে প্রকৃতির সঙ্গে খবরদারি না করে নদীকে তার নিজের মতো চলতে দেওয়া ভালো। নদীর একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তা রোধ করা ঠিক না।

নদী বিপন্ন হলে মানুষের সংস্কৃতি কি ঝুঁকিতে পড়বে?
নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নাগরিক সভ্যতা। মানুষ লোভে পড়ে নদী দখল করে সেখানে অট্টালিকা বানিয়েছে, কারখানা স্থাপন করে দূষণ করছে। কিন্তু নদী নিজে কথা বলতে না পারলেও তা কষ্টের কথা বুঝিয়ে দেয় মানুষকে বিপন্ন করে। যে নদী এ সময় লাখো মানুষের জীবিকা ছিল, সেখানে জাহাজ, পালতোলা নৌকা ও মাঝি জেলেদের কর্মব্যস্ততা ছিল, সেখানে এখন বালুচর। নদী পাড়ের এসব মানুষ বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে, নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে তার শেষ ইচ্ছার কথা লিখে গেছেন। তিনি গড়াই নদীকে ঘিরে নিজের পুনঃজন্মের ইচ্ছা ও স্বপ্ন দেখেছেন- ‘আর কি কখনো এমন প্রশান্ত সন্ধ্যা বেলায়, এই নিস্তব্ধ গড়াই নদীর ওপর, বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জালিবোটের ওপর বিছানা পেতে পড়ে থাকতে পাব! হয়তো আর কোনো জন্মে এমন একটি সন্ধ্যাবেলা আর কখনো ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্য পরিবর্তন হবে-আর, কি রকম মন নিয়েই বা জন্মাব।’ রবীন্দ্রনাথ ও লালন আমার দুই নয়ন। ব্যক্তিজীবনে তারা আমার সঙ্গেই থাকে। গড়াই নিয়ে তাদের এ আকুতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। আজ রবীন্দ্রনাথ থাকলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, গড়াইয়ের করুণ পরিণতি হতো না।

গড়াই বাঁচাতে আপনি কী করছেন?
গড়াই নদীর সমস্যাগুলো আমাদের সবার। আমার নিজের দায় ও ভাবনা থেকে ২০০৩ সালে গড়াই এরিয়া ওয়াটার পার্টনারশিপ নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে দেশ-বিদেশে গড়াইয়ের সমস্যা তুলে ধরছি। আমি ভারতেও পানিবিষয়ক বিভিন্ন সম্মেলনে গেছি, সেখানে জোরালোভাবে গড়াইয়ের সমস্যা তুলে ধরেছি। বলেছি, ফারাক্কার কারণে কী সমস্যা হচ্ছে। কুষ্টিয়ায় এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারসহ ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। আমরা এ সময়ের মধ্যে বহুবার গড়াই এলাকার মানুষের অংশগ্রহণে মানববন্ধন ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছি। নানাভাবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের কাছে সমস্যার কথা তুলে ধরেছি।

নতুন কী কর্মসূচি রয়েছে আপনাদের?
আমরা মূলত, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচিগুলো বেশি করি। এখন অপরিকল্পিত ব্রিজের ফলে গড়াইয়ের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এ ধারা অব্যাহত থাকলে পানি প্রবাহ জিরোতে নেমে আসবে তা বোঝানোর জন্য আমরা একটি ডকুমেন্টারি করছি। বর্তমান প্রজন্ম অনলাইনের মাধ্যমে মোবাইল ও কম্পিউটারে সহজে গড়াইয়ের সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারবে। একই সঙ্গে গড়াই বাঁচাও আন্দোলনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে নানাভাবে সচেতন করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে আমাদের নিয়মিত প্রকাশনার সঙ্গে নতুন বিশেষ বুলেটিন যোগ হচ্ছে।

গড়াই বাঁচাতে আপনি কতটা আশাবাদী?
আমার বিশ্বাস, মানুষ জেগে উঠবে। আজ যারা নদী দখল করে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কারখানা স্থাপন করেছে, সমাজের লোক তাদের আর ভালো চোখে দেখছে না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নদী দখলমুক্ত করতে যে অভিযান চলছে, তা সাধারণ মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে। এমনিভাবে নদীদূষণের বিপক্ষেও মানুষ জোরালো অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমনিভাবে মানুষ গড়াই রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবে। এর প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য, আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য সবাই মিলে একজোট হয়ে শক্তিশালী মোর্চা তৈরি করবে।

আপনাকে ধন্যবাদ
ধন্যবাদ। একটি কথা না বলে পারছি না, এই কাগজটি চলমান সংবাদের পাশাপাশি নদী ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে যেভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশ করে তার জন্য এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আপনার মাধ্যমে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button