জানা-অজানা

গভীর ঘুমের ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলো কী কী?

ঝিনাইদহের চোখঃ

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিকঠাক রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কম ঘুমানোর মতোই বেশি ঘুমানোটাও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আবার শৈশবে, কৈশোরে, তারুণ্যে, যৌবনে আর বার্ধক্যে ঘুমের চাহিদাও আলাদা আলাদা। তবে সঠিক পরিমান মতো ঘুম না হলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। আজ আলোচনা করবো গভীর ঘুমের ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলো কী কী ।

১. ডিজিটাল পর্দা : চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, আগে মনে করা হতো, পারিবারিক বা পেশাগত কারণে যতটা ঘুম ডিসটার্বড হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ডিজিটাল পর্দার প্রভাবে। একজন মানুষ যদি দিনে দুই হাজার বার স্মার্টফোন টাচ করে তাহলে তার ঘুম আসবে কীভাবে?

আমরা সবাই আজ চারকোণা স্ক্রিনের দুনিয়ায় বন্দী। সারাদিন পর বাড়িতে ফিরে রাত জেগে বা গভীর রাত অবধি টিভি, ট্যাব,ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনের সামনে না বসে আমরা রিল্যাক্স করতে পারি না। বাড়ির মা-বাবা থেকে ছোট্ট শিশু সন্তান সবাই যার যার ডিভাইস নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমরা জানি, ভোগবাদী পুজিঁপতিরা নিত্যনতুন ইলেক্ট্রনিক পণ্যের মাধ্যমে আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টায় তৎপর। কোনোরকম রাখঢাক না রেখে নেটফিক্স নামক সাইটটি ঘোষণা করেছে তাদের ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী/ শত্রু মানুষের ঘুম। তারপরও আমরা রাত জেগে এসব সাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসি।

টিভি বা স্মার্টফোনে আসলে আমরা কী করছি বা দেখছি? নিত্য নতুন স্নায়ু উত্তেজক খবর শুনছি, হরর ফিল্ম দেখছি বা টিভি সিরিয়াল দেখছি। উত্তেজনক দৃশ্য দেখলে নার্ভ ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। আর ঘুমোতে যাওয়ার পরও যতক্ষণ পর্যন্ত নার্ভাস সিস্টেমের শান্ত না হচ্ছে ততক্ষণ ঘুম আসছে না।

ব্রেনের মেডুলা ও মিডব্রেনের মাঝখানে রয়েছে আমাদের ওয়েকিং সেন্টার বা জাগৃতি কেন্দ্র। জাগৃতি কেন্দ্র যখন কাজ করে তখন আমরা জেগে থাকি। আর এ কেন্দ্রটি যখন কাজ বন্ধ করে দেয়, তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। জাগৃতি কেন্দ্রের কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় হরমোন সংকেত দ্বারা। আর এই হরমোন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় শরীর মনের অবস্থা দ্বারা।

শরীর মনের অবস্থা অনুসারে হরমোনের মাত্রা কমতে কমতে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় এলে জাগৃতি কেন্দ্র কাজ বন্ধ করে দেয়, ফলে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ডিজিটাল পর্দা, অর্থাৎ টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আমাদের শরীরের এই হরমোনের মাত্রা কমতে দিচ্ছে না। আমাদের ব্রেনকে ক্রমাগত জেগে থাকার উদ্দীপনা দিচ্ছে। ফলে ব্রেনের কাজ বন্ধ হচ্ছে না এবং আমরা ঘুমাতেও পারছি না।

এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক রাতে টেলিভিশন, কম্পিউটার বা সেলফোন মনিটরে তাকিয়ে থাকা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। কারণ টেলিভিশন, কম্পিউটার বা সেলফোন মনিটরে যে নীল আলো থাকে, তা চোখের রেটিনার মাধ্যমে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে চলে গিয়ে মেলাটোনিন নামের রাসায়নিক নিঃসরণে দেরি করিয়ে দেয়। মেলাটনিন যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ নিঃসরিত না হয় তাহলে গভীর ঘুম হয় না।

২. জীবনে ছন্দায়ন না থাকলে : ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, পড়ার সময় পড়া, ঘুমানোর সময় ঘুমানো, খেলার সময় খেলা করতে হবে। আমাদের জীবনে এখন কোনো রুটিন নেই। একেক দিন একেক সময় ঘুমাতে যাচ্ছি, একেক সময় ঘুম থেকে জাগছি। সময়ের কাজ সময়ে করতে পারছি না।

অনেকে বলেন ক্রমাগত রাত জেগে সয়ে গেছে অর্থাৎ তার কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, ক্ষতি যা হওয়ার তা ঠিকই হচ্ছে, হয়তো আপনি টের পাচ্ছেন না। পানশালায় বসে থাকা একজন মাতাল ড্রাইভার যেমনি গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বলে, আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আপনি জানেন, তার অবস্থা ভালো নয়, এ অবস্থায় তাকে গাড়ি চালাতে দেয়া যাবে না।
ঘুমোনোর স্বাভাবিক নিয়ম : আসলে ২৪ ঘণ্টায় কতটা সময় ঘুমাবেন ব্যক্তিভেদে এটা নির্ভর করে। কারো ৬ ঘণ্টা ঘুমিয়ে দিব্যি কেটে যায় আবার কারো ক্ষেত্রে ৭-৮ ঘণ্টা। কতক্ষণ ঘুমের প্রয়োজন এটা নির্ভর করে ব্যক্তির দেহঘড়ির ওপর। তার খাদ্যাভ্যাস, হরমোন প্রবাহ, পরিবেশ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। যারা মেডিটেশন করেন তারা আধাঘণ্টা মেডিটেশন করে দুই ঘণ্টা সমপরিমাণ ঘুমের এনার্জি লাভ করে। রেম ঘুম বা গভীর ঘুম, এটার একটা চক্র আছে, ১.৫ ঘণ্টায় এক চক্র পূর্ণ হয়। আমরা চেষ্টা করব, ৩ চক্র, ৪ চক্র অর্থাৎ ৪.৫ ঘণ্টা, ৬ ঘণ্টা এভাবে ঘুমাতে। তাহলে ঘুম থেকে ওঠার পর ক্লান্তি থাকবে না।

মহামতি বুদ্ধের জীবনে একটি ঘটনা আছে। বুদ্ধের সাথে কয়েকজন সাধনা শুরু করেছিলেন। বুদ্ধ দিনের কিছু সময় ঘুমিয়ে কাটালেন, খিদে পেলে ফলমূল খেতেন। তার সাথের সাধকরা মনে করলেন যে, বুদ্ধকে শয়তান ধরেছে, তার সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়, তার সাথে থাকলে তারাও শয়তান দ্বারা আক্রান্ত হবো। তাই তাকে ছেড়ে তখন চলে গেলেন। কিন্তু তারা কেউই সিদ্ধি লাভ করতে পারেন নি। পেরেছিলেন একমাত্র বুদ্ধই। কারণ তিনি জানতেন যে-কোনো কাজে সফল হতে গেলে শরীরের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। তাই তিনি সাধনার পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণ খেতেন এবং ঘুমাতেন।

তবে কেউ যদি আবার মনে করে বসেন বেশি ঘুমালে শরীর বেশি ভালো থাকবে, তাহলে সেটিও ভুল। গবেষণায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অতিরিক্ত ঘুমের সাথে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও অপরিণত বয়সে মৃত্যুর সাথে সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। সাধারণত যারা একটু আলসেমি করতে পছন্দ করেন কিংবা হতাশায় ভুগছেন তারাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমান। অতিরিক্তি ঘুম শুধু দেহের নয়, আত্মারও মৃত্যু ঘটায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button