পাঠকের কথা

মাথায় যন্ত্রনা করলে কি মাথা কেটে ফেলতে হবে ?—সাহিদুল এনাম পল্লব

ঝিনাইদহের চোখঃ

সমাজ পরিবর্তন হয় প্রকৃতির যথাযথ নিয়মে,কালের ধারাবাহিকতায় সময়ের প্রয়োজনে । যে মাঝি নদীতে ভাটিয়ালি গান গেয়ে নৌকা চালাত,যে গাড়োয়ান গান গেয়ে গরুর গাড়িতে গায়ের বধূ,মাঠের কৃষকের উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলত,সেই মাঝি,গাড়োয়ান আজ কালের বিবর্তনে নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভদভদি চালক। এই পরিবহন গায়ের রাস্তা দিয়ে অতি সহজে কৃষকের ক্ষেতের উৎপাদিত শস্য কম খরচে পৌছে দিচ্ছে গ্রাম ও শহরের হাটবাজার গুলোতে। গায়ের যে বধূরা নৌকা কিম্বা ঘোড়ার গাড়ীতে অথবা গরুর গাড়ীতে মা-বাবার বাড়ী ও শহরে যাতায়াত করত তারা এখন গ্রাম-গঞ্জে যাতায়াত করে এই নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভদভদিতে। নৌকা,গরুর গাড়ী,ঘোড়ার গাড়ী তৈরি করতে প্রয়োজন হত গ্রামের বাঁশ,গাছের কাঠ । তেমনি এই পরিবহন তৈরি করতে গ্রামের কাঠ ছাড়া প্রয়োজন হয় বিদেশ থেকে আমদানিকৃত শ্যাল ইঞ্জিন । যাহার শুল্ক আমদানির সময় রাষ্ট্র পেয়ে থাকে। প্রচীন বাংলার গরুর গাড়ি,ঘোড়ার গাড়ির ও নৌকার আধুনিক পরিবর্তিত রূপ হল এই নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভডভডি পরিবহন।

আজ এক শ্রেণীর পুঁজিবাদের দালাল,কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের রক্ত ও শ্রম শোষণকারী গোষ্ঠী বলছে যে এই পরিবহন অবৈধ এদের রাস্তায় চলার কোন অধিকার নেই। কারন এই পরিবহনের লাইন্সেস নাই,এদের রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি নাই,এরা রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটায়,এদের চালকের লাইসেন্স নাই,ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এদের রাস্তায় চলতে দেওয়া যাবে না বন্ধ করতে হবে ।

প্রচীন বাংলার নদীগুলিতে যে মাঝিরা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত সেই মাঝিদের কি মাঝির কোন লাইসেন্স ছিল?প্রাচীন গ্রামবাংলার একমাত্র পরিবহন ঘোড়া অথবা গরুর গাড়ী এই পরিবহনের গাড়োয়ানের কি কোন লাইসেন্স ছিল?এদের চালক হিসাবে কি কোন স্বীকৃতি ছিল?এদের নিকট থেকে ইউনিয়ন পরিষদ কি কোন শুল্ক আদায় করত?এই পরিবহন গুলি কোন কোম্পানি তৈরি করত না । গ্রামের মিস্ত্রীরা এই পরিবহন তৈরি করত যাহাদের রাষ্ট্র কর্তৃক কোন স্বীকৃতি ছিল না । ছিল না তাদের রাষ্ট্রের কোন লাইসেন্স । কোন লাইসেন্স বিহীন গ্রামের মিস্ত্রীর তৈরি কৃত নৌকা,গরুর গাড়ী,ঘোড়ার গাড়ীকে কেহ অবৈধ বলতে পারে নাই । সেই দেশীয় স্থানীয় প্রযুক্তির তৈরি পরিবহন যদি অবৈধ না হয়ে থাকে,তাহলে আজকের দেসীয় স্থানীয় প্রযুক্তির তৈরি নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভদভদি পরিবহন কি ভাবে অবৈধ হবে?

এই পরিবহন তৈরি করতে শ্যাল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়,আর এই শ্যাল ইঞ্জিন আমদানি করা হয় অন্য দেশ থেকে। এই ইঞ্জিন আমদানির শুল্ক কি সরকার পায় না ?ইহা থেকে কি রাজস্ব আসে না ?তাহলে কোন প্রক্তিয়ায় এরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে থেকে?আবার অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে সড়কে এদের কারনে অধিক দুর্ঘটনা ঘটে। ওনারা কি বলতে পারবেন এই পরিবহন রাস্তা ঘাটে চলাচল না করলে রাস্তায় কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে না?নৌকা ডুবিতে কি মানুষ মারা যাই নি ? প্রতি বছর লঞ্চ ডুবিতে অথবা বাস-ট্রাক,ট্রেন ও উড়োজাহাজের সাথে দুর্ঘটনা কত মানুষ মারা যায় এবং জীবনের মত পঙ্গুত্ব বরন করতে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের। তার জন্য কি বলা হয়েছে যে নৌকা,লঞ্চ-স্টিমার,বাস-ট্রাক,ট্রেন ও উড়োজাহাজ চলা চল বন্ধ করতে হবে?তাহলে কেন কোন কারন দেখিয়ে এই পরিবহন বন্ধ করতে হবে?রাস্তার চলাচল করলে দুর্ঘটনা ঘটবে এই জন্য তো রাস্তায় চলাচলের পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। দেশের সিংহ ভাগ দুর্ঘটনার কারন দেখিয়ে যারা এই পরিবহন বন্ধের কথা বলছে তাঁদের কে বলছি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনার মাত্র ০.৩৫% দায়ী এই নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভদভদি চালকেরা ।

গ্রামের সাধারণ মানুষ এই পরিবহন বন্ধ করতে চায় না,কারন বিপদে আপাদে গ্রাম থেকে বিভিন্ন রোগী সহ মালামাল নিয়ে হাসপাতাল ও শহরের হাট বাজার গুলিতে পৌঁছে দিয়ে অতি উপকারি বন্ধুর ভুমিকা পালন করছে এই পরিবহন। তাই গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ সহ যারা ক্ষুদ্র ব্যাবসা করে জিবিকা নির্বাহ করে তারা চায় না এই বন্ধু পরিবহন টি তাঁদের নিকট থেকে সরে যাক । এই পরিবহন না থাকলে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসাহী সহ কোটি কোটি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আজ সারা দেশে প্রায় পনের লক্ষ নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভদভদি চালক রয়েছে তার সাথে তিন হাজার মত ওয়ার্কশপ এবং প্রায় পঞ্চাশ টি ছোট্ট বড় কারখানা গড়ে উঠেছে । এই পরিবহন চালিয়ে চালকেরা এবং কারখান ও ওয়ার্কশপ কাজ করে মালিক ও শ্রমিকরা তাঁদের পরিবারের সন্তান সন্তানাদির খাওয়া-দাওয়া,লেখাপড়া,চিকিৎসা খরচ বহন করে জীবন ধারন করছে। দেশের প্রায় এক কোটি সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা এই পরিবহনের সাথে জড়িত। এই পরিবহন দেশের পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ শিশুর লেখাপড়ার খরচ বহন করছে। সর্বপরি পনের লক্ষ যুবকের আর্তকর্মসংস্থান গড়ে তুলে দেশের অর্থনীতিতে বেকার সমস্যা সমাধানে ব্যপক ভুমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক সংকটের কারনে অবরোধ হরতালের বিকল্প পরিবহন হিসাবে কাজ করে এই পরিবহন।

এই পরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে দেশের কি কি সমস্যা হবে?

প্রথমত,দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ১৫ লক্ষ বেকার যুবকের অবদান বন্ধ হয়ে পনের লক্ষ বেকার বৃদ্ধি পাবে। তাহতে গ্রামীণ জীবনে সামাজিক চরম বিঃশৃঙ্গলা দেখা দেবা। দেশে চুরি,ডাকাতি,ছিনতাই,খুন রাহাজানি ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে আইন-শৃঙ্গলা ব্যবস্থার চরম অব উন্নতি ঘটবে।

দ্বিতীয়ত,কৃষক তার ফসলের নায্য মুল্য থেকে বঞ্চিত হবে । যাহার কারনে কৃষক কৃষিতে কাঁচা তরিতরকারি উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে এবং কাঁচা মাল উৎপাদন কমে যাবে। কৃষকের উৎপাদিত কাঁচা মালের পরিবহন ব্যায় বেড়ে যাবে। কৃষকের উৎপাদিত শাঁক-সবজি,ধান-চাউল,ডাউল,মাছ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য একদিকে শহরের মানুষের উচ্চ মুল্যে ত্রয় করতে হবে অন্যদিকে কৃষকের উৎপাদিত শাঁক-সবজি পরিবহনের অভাবে ক্ষেতে বিনষ্ট হবে।

তৃতীয়ত,দ্রব্য মুল্য বেড়ে যাওয়ার কারনে দেশের মানুষের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি গ্রস্ত হবে। সরকারের পক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতি রোধ করা সম্ভাব হবে না।

চতুর্থত,পাঁচ থেকে সাত লক্ষ শিশুর শিক্ষা জীবন ঝরে পড়বে । তাহাছাড়া শিক্ষারত অনেকের শিক্ষা জীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। তার সাথে দেখা দেবে দেশের এক কোটি মানুষের খাবারের অনিশ্চয়তা।

পঞ্চমত,দেশে যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা চরম ভাবে ক্ষতি গ্রস্ত হবে। যাহার কারনে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসাহী তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। দেশের এন জি ও ব্যাংকের ঋণ নিয়ে যারা এই পরিবহন ও কারখান তৈরি করেছেন তারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবে এবং ঋণ খেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

সর্বপরি দেশে এক ভয়ভহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে ,তাহাতে দেশের আইন-শৃঙ্গলার অবনতি,কৃষকের দুর্গতি,সমাজের শান্তি বিনষ্ট,ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে দেশে চরম বিঃশৃঙ্গলা দেখা দেবে। দেশের ১৬ কোটি মানুষ পরিবহন মালিকদের সিন্ডিকেটের অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে।

প্রয়োজন আইন মানে না । আইন তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে। একটি মানবাধিকার সংগঠনের বিতর্কিত মামালার বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশের মানুষের জীবন জীকার উপর যে প্রভাব পড়বে তাহা সরকারকে ভাবতে হবে । যে মামলার কারন দেখিয়ে এই যানবাহন বন্ধের কথা উঠেছে তার জন্য এই পরিবহন সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনার মাত্র ০.৩৫% দায়ী এই নছিমন–করিমন-আলমসাধু-ভদভদি চালকেরা বলে দেখা গেছে এক সমীক্ষায়। ।

এই পরিবহন কার স্বার্থ বিনষ্ট করছে?এই পরিবহন চলাচলের ফলে বাস-ট্রাকে করে অতি নিকট বর্তি মালামাল বহন কমে গেছে। গ্রামের অতি সাধারণ কৃষকের পরিবহন মালিকদের সিন্ডকেটের বেড়াজালে আবন্ধ হতে হয় না। এই জন্য বাংলাদেশের পরিবহন মালিক সমিতি ও বিদেশী এজেন্ট যারা বহু জাতিক কোম্পানি গুলির স্বার্থ রক্ষা করে,তারা তাঁদের নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য এই যানবাহন বন্ধ করে দিতে চায়। তাঁদের সাথে হাত মিলিয়েছে সরকার ও প্রশাসনের একটি অংশ যারা এই পরিবহন মালিক সমিতির ও বহু জাতিক কোম্পানি গুলির স্বার্থ রক্ষা করে। তারা মুলত দেশের ও সাধারণ মানুষের বন্ধু নয়।

মাথায় যন্ত্রনা করলে মাথা না কেটে ফেলে মাথায় ঔষধের ব্যবস্থা করতে হবে,মাথা কেটে ফেলা কোন ব্যবস্থা নয়। তদ্রূপ এই পরিবহনে যে যে ত্রুটি বিচুতি আছে তাহা সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহা না হলে হাইওয়ের পাশ দিয়ে চলাচলের জন্য বাইপাস সড়ক নির্মাণ করে সারা দেশে তাঁদের চলাচলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাহাতে বিকল্প পথে তাহারা শহরে আসতে পারে । চালকদের জন্য সু-নিদ্রিট নিতি মালা তৈরি করে তাঁদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে । হাইওয়েতে যাত্রী বহনের বিধি আরোপ করতে হবে। এই গাড়ি ও চালক দের লাইসেন্স দিতে হবে । এই ভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাঁদের কে সংশোধন করে চলা চলের ব্যবস্থা করতে হবে । বন্ধ করে দেওয়া কোন সমস্যার সমাধান নয় । এই বন্ধ করে দেওয়াটা হবে মাথায় যন্ত্রনা করলে মাথা কেটে ফেলার শামিল ছাড়া এই কিছুই নয়।

সাহিদুল এনাম পল­ব,
০১৯৮৯৪১৪৬৪১

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button