#ঝিনাইদহের চোখঃ
পি.ডি.আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন সুকুমার সাহা। দীর্ঘদিন এই বিদ্যালয়ে ছাত্র পড়িয়েছেন, কিন্তু কোনো বেতন পাননি। বেতন ছাড়াই তাকে চাকুরী থেকে অবসরে যেতে হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিও ভুক্ত না হওয়ায় বিনা বেতনে পাঠদান করতে হয়েছে এই গনিত শিক্ষককে। এখন খালি হাতে পরিবারে ফিরে লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারেন না। সারাক্ষন নিজেকে লুকিয়ে রাখেন।
সুকুমার সাহা’র জন্ম ১৯৫৮ সালে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার সারঙ্গদিয়া গ্রামে। বাবা মৃত ফনিন্দ্রনাথ সাহা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার প্রয়োজনে ১৯৬৭ সালে চলে আসেন ঝিনাইদহে। এই শহরের মদনমোহন পাড়ায় বসবাস শুরু করেন। আজো বাবার রেখে যাওয়া সেই বাড়িতেই সুকুমার সাহা বসবাস করছেন।
সুকুমার সাহা জানান, বিএসসি কোর্স শেষে বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশুনা করতেন তিনি। বাবার তখন মুদি দোকান ছিল। ১৯৮৯ সালে তিনি পৃথক দোকান নেন। কালীগঞ্জ শহরের বিমল কুমার সাহার কন্যা উৎপলা সাহাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের সংসার মোটামুটি ভালোই চলছিল। অল্প দিনেই তাদের ঘরে আসে সজিব কুমার সাহা ও দীপ্ত সাহা নামের দুই সন্তান। বর্তমানে তারা দু’জনই পড়ালেখা করছে।
সুকুমার সাহা জানান, ১৯৭৫ সালে ঝিনাইদহ নিউ একাডেমি থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এইচ.এস.সি ও ১৯৮১ সালে বিসিএস কোর্স সম্পন্ন করেন। ৮২ সালে এম.এস.সি কোর্স করতে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ৮৫ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়ালেখা করে পারিবারিক সমস্যায় বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে এসে বাবার ও নিজের ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। এরই মধ্যে ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার দিঘলগ্রাম গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় পি.ডি.আর (পিড়াগাতি-দিঘলগ্রাম-রুপদাহ) মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্টার পর ওই প্রতিষ্টানের সঙ্গে যুক্তরা সেখানে পড়ানোর জন্য কোনো গনিতের শিক্ষক পাচ্ছিলেন না। তখন তাকে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেন।
সুকুমার সাহা আরো জানান, ব্যবসায়ী থেকে শিক্ষক এটা তার কাছে খুব ভালো লেগেছিল। তিনি প্রতিষ্টানের কর্মকর্তাদের অনুরোধে চাকুরীর জন্য আবেদন করেন। কর্তৃপক্ষ ২০০৪ সালে তাকে নিয়োগ দেন। এরপর থেকে তিনি ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের গনিত পড়াতেন। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসরে গেছেন। কিন্তু এই চাকুরী সময়ে তিনি কোনো বেতন পাননি। এমনকি বিদ্যালয়টি হতদরিদ্র এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেখানেও তেমন কোনো আয় ছিল না। যে কারনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তিনি কিছুই পাননি। আবার প্রতিষ্টানে বেশি সময় দেওয়ায় নিজে কোনো প্রাইভেট পড়ানোর সঙ্গেও যুক্ত হননি। এরই মধ্যে আরো ভালো পাঠদানের স্বার্থে ২০০৯ সালে তিনি বিএড কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, কর্মজীবন শেষ করলেন বেতন ছাড়া। যাবার সময়ও কিছুই পেলেন না। এই অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের সামনে মুখ দেখাতে এখন খুব কষ্ট হয়। তারপরও মাঝে মধ্যে প্রতিষ্টানে যান, সেখানে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে সময় কাটান। তিনি জানান, স্ত্রী উৎপলা সাহা একটি প্রি-ক্যাডেট স্কুলে শিক্ষাকতা করে। বাড়িতে কিছু বাচ্চা পড়ান তিনি। তার টাকায় চলে সংসার। তার এই কঠিন জীবন নিয়ে কারো কি কিছুই করার নেই এই প্রশ্ন সুকুমার সাহার।
পিডিআর মাধ্যামিক বিদ্যালয় এর বর্তমান প্রধান শিক্ষক আক্রামুল কবির জানান, এলাকার কিছু শিক্ষানুরাগী ২০০০ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১ শত শকত জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে ২৪৫ জন ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করছে। ৮ জন শিক্ষক আর ৩ জন কর্মচারি রয়েছে প্রতিষ্টানে। বিদ্যালয়ে রয়েছে ৭ টি শ্রেণী কক্ষ, ১ টি শিক্ষকদের কক্ষ ও ১ টি শিক্ষার্থী কমন রুম। তাদের প্রতিষ্ঠানের উত্তরে ৪ কিলোমিটার দুরে ফলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দক্ষিনে ৫ কিলোমিটার দুরে মধুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পূর্বে ৬ কিলোমিটার দুরে শেখরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিমে ৭ কিলোমিটার দুরে হিরাডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
তাদের প্রতিষ্টানে শিক্ষার্থীর অনেক। পিড়াগাতি, দিঘলগ্রাম, রুপদাহ, ,মান্দারতলা, করিমপুর ও আশুরহাট গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এই প্রতিষ্টানে পড়ালেখা করে। এ পর্যন্ত তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ টি ব্যাচ এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। শতকারা ৮৫ থেকে ৯০ এর উপরে পাশের হার থেকেছে। তারপরও প্রতিষ্ঠানটি এমপিও ভুক্ত হয়নি। যে কারনে সুকুমার সাহাকে বেতন ছাড়াই চলে যেতে হয়েছে। আরো কয়েকজন আছে তাদের অবস্থাও একই। প্রতিষ্টানটি দ্রæত এমপিও ভুক্তি না হলে ওই শিক্ষকদের অবস্থাও সুকুমার সাহার মতোই হবে।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামীম আহম্মেদ খাঁন জানান, বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ের। এই সব শিক্ষকদের নিয়ে তাদের কিছুই করার ও বলার সেই। তবে শিক্ষকরা উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন কিছু হয় কি না।