১৩০ তম প্রয়াণ দিবসে জেনে নেই লোককবি “পাগলা কানাই”র সম্পর্কে
#শামীম আহম্মেদ, ঝিনাইদহের চোখঃ
ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, পাগলা কানাই ১৮০৯ সালে বাংলা ১২১৬ এর ২৫ শে ফাল্গুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের লেবুতলা গ্রামের এক দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কানাই শেখ তাঁর প্রকৃত নাম, পিতার নাম কুড়ন শেখ এবং মায়ের নাম মোমেনা বিবি। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে কানাই ছিলেন সবার বড়। তাঁর ভাইয়ের নাম উজল শেখ, বোনের নাম স্বরনারী। বোন স্বরনারীর বিবাহ হয়েছিল বেড়বাড়ি গ্রামে। কবির কৈশর থেকে মৃত্যু অবধি নিবাস ছিল বেড়বাড়ি গ্রাম, এখানেই তাঁর মাজার রয়েছে। এই লোককবির প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু গান রচনা করার বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একের পর এক গান রচনা করতে পারতেন। হাজার হাজার শ্রোতা তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে আহার-বিহার ত্যাগ করে ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্য সহকারে তাঁর গান শুনে যেতেন। এ প্রসঙ্গে কাঙাল হরিনাথ বলেন, “কানাই এর গান শুনলে লোকে পাগল হইয়া যায়”।
পাঠশালায় পড়াকালে তাঁর বাবা কুড়ন শেখ মারা যান। পিতৃহারা হয়ে কানাই ভবঘুরে হয়ে যান। জীবনের তাগিদে মোমেনা বিবি কোনো উপায়ান্তর না দেখে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চেউনে ভাটপাড়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে কিছুদিনের মধ্যে তিনিও মারা যান। মা হারিয়ে কানাই শেখ ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ড উপজেলার বলরামপুরে ভরস মণ্ডলের বাড়িতে রাখালির কাজ করতেন।এরপর কিছুদিন মাগুরা জেলার আঠারখাদার জমিদার চক্রবর্তী পরিবারের বেড়বাড়িস্থ নীলকুঠিতে দুই টাকা বেতনে খালাসির কাজ করেন। সেই খালাসির চাকরি বেশি দিন করা হয়ে ওঠেনি। গানের প্রতি টানে চাকরি ছেড়ে-ছুড়ে পথে বের হন আবারও। পরবর্তিকালে তিনি আশ্রয় গ্রহন করেন বোনের বাড়ি আর্থাৎ স্বরনারী বেগমের শ্বশুরালয়ে । এ বেড়বাড়ি গ্রামেই প্রকৃত পক্ষে পাগলা কানাইয়ের কীর্তিধারিনী বলে পরিচিত।
বোন স্বরনারীর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো হওয়াতে কানাইয়ের গান চর্চার রাস্তা আরও সহজ হয়। কানাই বোনের বাড়ির গরুর পাল চরাতেন আর গান বাঁধতেন এবং তাতে সুর দিতেন।
সুর দেওয়া হয়ে গেলে আপন মনে গলা ছেড়ে তা গাইতেন। অস্থির পাগল এই স্বভাবকবির কোনো জায়গায় বেশি দিন ভালো লাগত না। সব ছেড়ে-ছুড়ে পথে বের হন আবারও।
ছোটবেলা থেকেই পাগলাকানাই দুরন্ত প্রকৃতির, পাগলাটে স্বভাবের এবং আধ্যাত্ম প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এ খেয়ালীপনার জন্যে শৈশবে স্নেহবশতঃ লোকে তাঁর নামের সাথে “পাগলা’ অভিধাটি (উপনাম) যুক্ত করে। তাঁর কর্মকীর্তির সাথে এ পাগলা উপাধিটি অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে।
গরু চরাতে গিয়ে ধুয়া জারীগান গাইতেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গীত মুগ্ধ হয়ে শুনত। এভাবে ধুয়োজারীতে তাঁর হাতে খড়ি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর কোন সঙ্গীত শিক্ষা না থাকলেও এখানকার তৎকালীন আউল-বাউল, সাধু-ফকির প্রভৃতি গুণীজনের পদচারণা সর্বোপরি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির আত্মার আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-অন্বেষণ তাঁকে প্রখর অধ্যাত্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তোলে। তাঁর গানে ইসলাম ও আল্লাহর প্রিয় নবীর, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ), প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়। পাগলা কানাই নিরক্ষর হলেও তাঁর স্মৃতি ও মেধা ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে একের পর এক গান রচনা করতে পারতেন। তিনি যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা রাজশাহী, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ গান গেয়ে বেড়াতেন।
পাগলা কানাই তাঁর শিষ্য ও ভক্তদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আখড়া বেঁধে গান গেয়ে বেড়াতেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ছিল ইঁদু বিশ্বস, সুলতান মোল্লা,অমেদ আলী, ছাবের আলী,ছমির উদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তিনি মুসলমান ছিলেন বলে নামাজ আদায় করতেন এবং ইসলাম ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে বহু সংগীত রচনা করেছেন।
এ পর্যন্ত পাগলা কানাই রচিত গানের মধ্যে ৪০০ শ ও বেশি গান সংগৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড, মাযহারুল ইসলাম, অধ্যপক আবু তালিব, আমিন উদ্দিন শাহ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, উপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য প্রমুখ মনীষীগণ পাগলা কানাইয়ের গানের সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন।
বাংলার প্রখ্যাত অনেক মনীষী পাগলা কানাই সম্পর্কে নানা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
অধ্যাপক মুহম্মদ আবুতালিব বলেছেন, সামান্য জারি গানের বয়াতি পাগলা কানাই তাঁর গানে যে অসাধারন রস সৃষ্টি ও পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন, শুধুমাত্র বাংলাদের ইকিহাস কেন, যে কোনো দেশের ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। পাগলা কানাইয়ের গান নানা শ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়, যেমন-জারি,ধুয়া,পালাগান,
কবিগান,মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের সুখ-দু:খের গান,দেহতত্বে, বাউল,মুর্শিদি,মারফতি, সমাজচিত্র, সমকালীন ঘটনার বর্ননা, ঐতিহাসিক কাহিনি, হামদ, নাত,সাধনতত্ব,ধর্মতত্ব, ইসলামধর্মীয় আদর্শ, প্রেমের মহিমা, ও লোকশিক্ষামুলক সংগীত উল্লেখযোগ্য ।
পাগলা কানাই ছিলেন সকল প্রকারের সংকীর্ণতার উর্ধে। জাতি, ধর্ম,বর্ণ, সম্প্রদায় ভিত্তিক কোনো ভেদনীতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। এ কারনেই তিনি এ দেশীয় হিন্দু -মুসলমানের নিকট ছিলেন ‘ওস্তাদ’ বা ‘আচার্য’ । তাঁর গানের সারল্য ও ভাবের মর্মস্পর্শিতার গুনে প্রতিটি মানুষ তাঁকে ‘কবি’ বলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতো।
বেড়বাড়িতে তাঁর পাঁকা মাজার বিদ্যমান। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্তে গঠিত হয়েছে পাগলা কানাই স্মৃতি সংরক্ষন পরিষদ।
বাংলার পথে, দোতারা হাতে, গান গেয়ে ফেরা মরমী লোককবি পাগলা কানাই ১৮৮৯ (বাংলা ১২৯৬ সালের ২৮ আষাঢ়) সালে মৃত্যুবরণ করেন।