টপ লিডমহেশপুর

ঝিনাইদহে অন্যের জমিতে কামলা খেটে জিপিএ-৫

#ঝিনাইদহের চোখঃ

শাহিন আলম আর ছামসুল হক পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যের জমিতে কামলার কাজ করেন। সাইফুল্লাখ খালিদ আর আসাদুল্লাহ গালীব তারা যমজ দুইভাই। তারাও পরের ক্ষেতের কামলা। আনিকা ইয়াসমিন, শামীমা ইয়াসমিন ও কবুরা খাতুনের বাবারাও অন্যের জমিতে কাজ করেই সংসার চালান।

https://www.youtube.com/watch?v=lt8BLAqHUTI&t=5s

এই অদম্য মেধাবী ৭ শিক্ষার্থী ঝিনাইদহ মহেশপুরের মোঃ শহীদুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের এই ফলাফল গোটা এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, এই অদম্য মেধাবীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের মুখ উজ্জল করেছে। তারা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ রফিকুল আলম জানান, মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি এলাকা ভৈরবা। এই এলাকায় ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মোঃ শহীদুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ। বর্তমানে কলেজে শিক্ষক আছেন ৩৫ জন, আর কর্মকর্তা ও কর্মচারি ১০ জন। ১০৬৫ জন ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করছে। তিনি জানান, এবছর এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ২৫৮ জন নিবন্ধিত হন, কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেন ২৪৮ জন। যাদের সকলেই পাশ করেছেন। এর মধ্যে ৭ জন ছেলে-মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তারা হলেন শাহিন আলম, ছামসুল হক, সাইফুল্লাহ খালিদ, আসাদুল্লাহ গালীব, আনিকা ইয়াসমিন, শামীমা ইয়াসমিন ও কবুরা খাতুন। তিনি আরো জানান, তাদের কলেজটি পর পর চারবছর উপজেলার শ্রেষ্ঠ ও ২০১৯ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ নির্বাচিত হয়েছে।

অধ্যক্ষ আরো জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের সকলেই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে চারজন ছাত্র আছেন যারা নিজেরাই পরের জমিতে কামলার কাজ করেন। আর তিনটি মেয়ে আছেন, যাদের বাবারা অন্যের জমিতে কামলা খাটেন। এই সব হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের ফলাফলে শুধু তারা নয়, গোটা এলাকার মানুষ খুশি। আর্থিক কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে তারা সফলতা পেয়েছেন।

মহেশপুর উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামের আছের উদ্দিনের পুত্র শাহিন আলম (১৮)। তারা চার ভাই। শাহিন সবার ছোট। বড় ভায়ের মধ্যে দুইটা পড়ালেখা শেষ করে বর্তমানে বেকার। আকেরটা ভাই কৃষি শ্রমিক। শাহিন জানান, পরিবারের পক্ষে তার পড়ার খরচ জোটানো সম্ভব হয়নি। নিজেই কাজ করে খরচ জুটিয়েছেন। কখনও অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন, আবার কখনও রাস্তায় কামলা দিয়েছেন। এতো কষ্টের মধ্যেও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। এসএসসি পরীক্ষায় একটা বিষয়ে একটু খারাপ হয়ে যাওয়ায় জিপিএ-৫ হয়নি। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তিনি মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা, কিন্তু অন্তরায় অর্থ। তার ভাষায়, পরবর্তী পড়ালেখা কিভাবে হবে তা এখনও নিশ্চিত নন।

ছামসুল হক (১৮) পাশ^বর্তী রুলি গ্রামের রবিউল ইসলামের পুত্র। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয়। ভায়েরা সবাই কৃষক, অন্যের জমিতে কাজ করেন। তারা যা আয় করেন তা থেকে ছামসুলের পড়ালেখার খরচ হয়। সব সময় ঠিকমতো পয়সা দিতে না পারায় তাকের কাজে যেতে হয়। এভাবে পড়ালেখা করে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সাইফুল্লাহ খালিদ আর আসাদুল্লাহ গালীব এর বাবা আব্দুল গনি। আব্দুল গনি জানান, মাহফুজা খাতুন নামে তার আরেকটি মেয়ে রয়েছে। মেয়েটা দশম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে। নিজে অন্যের জমিতে কামলার কাজ করে এই তিন সন্তানের পড়ালেখার খরচ জোগাড় ঠিকমতো করতে পারতেন না। যে কারনে ছেলেরাও মাঝে মধ্যে অন্যের জমিতে কাজ করেছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, পরীক্ষার মধ্যেও তাদের পরের জমির ধান কাটতে হয়েছে।

শিক্ষকরা জানান, সামন্তা গ্রামের আজিজুর রহমান আনিকা ইয়াসমিন, ভৈরবা গ্রামের রমজান আরীর কন্য শামীমা ইয়াসমিন ও কচুয়ারপোতা গ্রামের আব্দুস সালাম মীর এর কন্যা কবুরা খাতুন। এরা সবাই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। এদের বাবারও অন্যের জমিতে কাজ করেন। মেয়েদের ঠিকমতো প্রাইভেট পড়াতে পারেননি। তারপরও তারা ভালো ফল করেছে। ছেলে-মেয়েরা জানান, তাদের কলেজের ইংরেজি শিক্ষক এ.এম ইদ্রিস আলী তাদের পড়ালেখার বিষয়ে খুব সহযোগিতা করেছেন। তিনি এই সব মেধাবীদের টাকা ছাড়াই পড়িয়েছেন। শিক্ষার্থী কবুরা খাতুন জানান, তার বাবা কলেজে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন যে ১০ টি করে টাকার প্রয়োজন হতো, তাও দিতে পারতেন না। যে কারনে তিনি সপ্তাহে ১ থেকে ২ দিন ক্লাস করতেন। চার কিলোমিটার পাঁয়ে হেটে কলেজে যেতে হতো তাকে।

এ বিষয়ে ওই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য আব্দুল মালেক জানান, এই সব সন্তানেরা তাদের গর্ব। এরা যে ফল নিয়ে এসেছে তাতে গোটা এলাকার মানুষ খুশি। তিনি আরো বলেন, একটু সহযোগিতা পেলে এরা সবলেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভালো ভালো চাকুরী করতে পারবে। আর তাদের হাত ধরে আগামীতে এলাকার উন্নয়ন হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button