কালীগঞ্জটপ লিড

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ১টি পাড়ায় ২২ জন ডেঙ্গু রোগি শনাক্ত

ঝিনাইদহের চোখঃ
প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগি পাওয়া যাচ্ছে মন্ডল পাড়ায়। এটা দেখে ভয় পেয়ে যান ওই পাড়ার যুবক সাগর হোসেন (২২)। একদিন সকালে বাড়ি ছেড়ে চৌগাছায় শশুর বাড়ি চয়ে যান। সেখানে ৫ দিন থেকে আবার বাড়ি ফেরেন, কিন্তু ডেঙ্গু রোগ থেকে রক্ষা পাননি তিনি। বাড়িতে আসার পরই শরীরে জ¦র অনুভব করেন। এরপর হাসপাতালে গেলে ধরা পড়ে তার ডেঙ্গু হয়েছে।

সাগর হোসেন জানান, শুধু তার নয় তার মা চম্পা বেগমও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা দু’জন এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি আরো জানান, তাদের পাড়ার রমজান আলীর পরিবারের ৩ সদস্য এই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গোটা মন্ডল পাড়ায় চলতি সেপ্টেম্বর মাসে কমপক্ষে ২২ জন নারী-পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

যাদের বেশির ভাগই চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, একটি শিশু এখনও খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই অবস্থা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের একতারপুর গ্রামের মন্ডল পাড়ায়।

রবিবার সরেজমিনে একতারপুর গ্রামের মন্ডলপাড়ায় গিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখা যায় বেশির ভাগই এই সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্ত হয়েছে। পাড়ার রমজান আলীর স্ত্রী শেফালী বেগম (৪৫) জানান, ৬ সেপ্টেম্বর তার মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী রাবেয়া খাতুন (১৫) শরীরে জ¦র অনুভব করে। এরপর তাকে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে মেয়ের সেবা করার সময় দুইদিন পর তারও জ¦র হয়। মেয়ের ১১ সেপ্টেম্বর আর তার ১৩ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু পরীক্ষা করে পজেটিভ ধরা পড়ে। এরপর বাড়িতে ছিল দুই ছেলে আর স্বামী। এদের মধ্যে ছোট থেলে আসিফ হোসেন (১৭) জ¦র নিয়ে হাসপাতালে আসে। তার পরীক্ষা করেও ডেঙ্গু ধরা পড়ে। আসিফ এখনও ঠিকমতো সুস্থ্য হয়নি। তারা মা-মেয়ে কিছুটা ভালো। তিনজনই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ওই পাড়ার ফকির মন্ডলের পুত্র জালাল মন্ডল জানান, তার শরীরে জ¦র দেখা দিলে হাসপাতালে যান। সেখানে ১৫ শত টাকা খরচ করে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ৯ সেপ্টেম্বর তার এই পরীক্ষা করানো হয়। জালাল মন্ডল জানান, তার আরেক ভাই মোশারফ হোসেন মন্ডল প্রথমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভাই মোশারফ হোসেনের ডেঙ্গু ধরা পড়ে ৩ সেপ্টেম্বর। এর ৫ দিন পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে ছেলে বিপুল হোসেন (২৮) এর।

মন্ডলপাড়ার অহেদ আলীর স্ত্রী নুরী বেগম আক্রান্ত হয়েছেন ২২ সেপ্টেম্বর। তার পুত্রবধু নার্গিস বেগম জানান, তার শাশুড়ী নুরী বেগম জ¦র হলে প্রথমে পল্লী চিকিৎসক এর কাছে যান। পরে অবস্থা আরো খারাপ হলে যান কালীগঞ্জ শহরের হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। দুইদিন ভর্তি থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। বর্তমানে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। পাড়ার মিন্টু মন্ডলের ছেলে তানভীর (৪) গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়। দু’দিন স্থানিয় চিকিৎসকে করেও জ্বর না সারায় কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে পরিক্ষা করে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। কয়েক দিন কালীগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও তার অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও অবস্থার কোনো উন্নতি না দেখে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেন। বর্তমানে শিশুটি খূলনা ২৫০ শষ্যা হাসপাতালে মুর্মূষ অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। তার শরীরে প্রতিদিনই রক্ত দিতে হচ্ছে। ১৪ সেপ্টেম্বর আক্রান্ত হয়েছেন আরশেদ আলী মন্ডলের স্ত্রী আনজুরা বেগম (৪০)। তিনি জানান, এখনও শরীর তেমন ভালো না, তারপরও বাড়িতে চলে এসেছেন। বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

মন্ডলপাড়ার যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারা হলেন ফজলুর রহমান মন্ডলের স্ত্রী মাজেদা বেগম (৫০), ফকির মন্ডলের ছেলে জালাল উদ্দিন মন্ডল (৪২), মোশারফ হোসেন মন্ডল (৬০), তার ছেলে বিপুল হোসেন (৩০), অহেদ আলী স্ত্রী নুরী বেগম (৩৬), আব্দুল রাজ্জাকের ছেলে শরিফুল ইসলাম (৪৫), মইন উদ্দিনের ছেলে রমজান আলী মন্ডল (৪৫), রফিকুল ইসলামের ছেলে সাহাবুল মন্ডল (১২), রমজান আলীর স্ত্রী শেফালী বেগম (৪৫), তার ছেলে আসিফ হোসেন (১৭), কন্যা রাবেয়া খাতুন (১৫), মৃত বাবর আলীর ছেলে সাবজাল হোসেন মন্ডল (৫০), বাবার আলীর ছেলে তাহাজ্জেল হোসেন (৪০), ছেলে আব্দুস সালাম (২৬), আশরাফ আলীর স্ত্রী আনজুরা বেগম (৪০), এলাহী মন্ডলের স্ত্রী চায়না বেগম (৬৫), জহিদুল ইসলামের স্ত্রী শর্মিলা আক্রার পপি (২৬), তরিকুল ইসলামের ছেলে তামিম ইকবাল (৭), আসলাম উদ্দিনের স্ত্রী চম্পা বেগম (৩৫), মীর আব্দুল করিমের স্ত্রী জহুরা খাতুন(৬০), মমিনুর রহমানের স্ত্রী কুটি বেগম (৫০) ও মিন্টু মন্ডলের ছেলে তানভীর (৪)।

স্থানিয় এক বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া ছেলে সাদ্দাম হোসেন জানান, তাদের গ্রাম একতারপুরে তিনটি পাড়া রয়েছে। এগুলো হচ্ছে বিশ^াসপাড়া, খন্দকারপাড়া ও মন্ডলপাড়া। এই মন্ডলপাড়ায় শতাধিক পরিবার বসবাস করে। যাদের প্রায় প্রতিটি পরিবারে মানুষের শরীরে জ¦র দেখা দিয়েছে। আর কমপক্ষে ২৫ জন ডেঙ্গু রোগি সনাক্ত হয়েছে। এগুলো সেপ্টেম্বর মাসেই ধরা পড়েছে। এঘটনায় তাদের পাড়ায় ডেঙ্গু আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে তারা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ছুটেছেন। এক পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে দুইদিন সামান্য ঔষধ স্প্রে করা হয়েছে। প্রথমদিন স্প্রে করতে আসলে তাদের মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। পরে আরেকদিন এসে ঔষধ ছিটিয়েছেন। তবে সেটা খুবই সামান্য। তিনি আরো বলেন, তারা গ্রামের ছেলেরা জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। গ্রামের মানুষের আশংকা তাদের এই মন্ডল পাড়ার বেশ কিছু ছেলে ঢাকায় থাকেন। সম্প্রতি তারা বাড়ি এসেছিলেন। এখান থেকে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে একমটি ধারনা তাদের।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যান কর্মকর্তা ডাঃ হুসাইন সাফায়াত জানান, বিষয়টি জেনে তারা হাসপাতালে আসা রোগিদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ও স্থানিয় ইউনিয়ন পরিষদকে তারা অবহিত করেছেন। স্থানিয় ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ওরফে সানা জানান, তারা বেশ কয়েকবার ওই পাড়ায় ঔষধ ছিটিয়েছেন। এমনটি পরিষ্কার অভিযানও করেছেন। তারপরও কেন এমন হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন। তবে বর্তমানে কম বলে দাবি করেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সূবর্ণা রানী সাহা বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি ওই এলাকার ইউপি সদস্যকে প্রধান করে তারা একটি কমিটি করেছেন। যারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কাজে সবাইকে সচেতন করার কাজ করছেন। এছাড়া ঔষধ ছিটানোর ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button