“প্রায় বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালের ডোঙ্গা”
মোঃ হাবিব ওসমান, ঝিনাইদহের চোখঃ
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালের ডোঙ্গা। নতুন জন্মের কাছে অদ্ভুদ নাম। নাম শুনতেই বোঝা যায় তাল গাছ বা তালের সাথে কোন না কোন সম্পর্ক রয়েছে। তালের ডোঙ্গা অথ্যাৎ তাল গাছ থেকে তৈরী ছোট নৌকা বিশেষ। ডোঙ্গা শব্দের মূল উৎপত্তি হয়েছে ডিঙ্গি থেকে। ডিঙ্গি অর্থ ছোট। তালের ডোঙ্গা মূলত নির্মান করা হয় তাল গাছ থেকে।
মাত্র ১ প্রজন্ম আগেও দেশের অধিকাংশ বিল ও হাওর এলাকায় প্রচুর তালের ডোঙ্গা দেখা যেত, কিন্তু কালের ¯্রােতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারনে তালের ডোঙ্গা আজ বিলুপ্তির পথে।
এক সময় বাংলাদেশের প্রায় সবকটি জেলার প্রতিটা গ্রামের মানুষের প্রধান বাহন ছিল তালের ডোঙ্গা! ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোহর, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, রাজশাহী সহ বিভিন্ন এলাকায় অঞ্চলে প্রচুর তালের ডোঙ্গার ব্যাবহার ছিলো। মূলত তালের ডোঙ্গা ব্যাবহার করা হতো মাছ ধরা, শাপলা তোলা, শামুক সংগ্রহ অথবা ¯্রােতহীন কোন বিল পার হওয়ার জন্য।
বিশেষ করে ঝিনাইদহের, কালীগঞ্জসহ এ জেলার বিভিন্ন উপজেলার নদি, বাওড়, খাল বিলে এখনো তালের ডোঙ্গা দেখা যায়।
প্রবীনরা বলেন এখনো বর্ষা মৌসুমে আমরা তালের ডোঙ্গার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করি। ঝিনাইদহ জেলার বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে জানা যায়, তালের ডোঙ্গা ¯্রােতের ভেতর থেকে চলতে পারে না। একসময় ছোট খাটো কাজ করার জন্য তালের ডোঙ্গা প্রশিদ্ধ ছিলো। বিনোদনের জন্য নদি ও খাল বিল এলাকায় আয়োজন করা হতো “ডোঙ্গার বাইচ”।
সর্বোচ্চ দুজন মানুষ এক সাথে ডোঙ্গায় চলাচল করতে পারতো, এর বেশি হলে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বর্ষা মৌসুমে চলাচলের জন্য তালের ডোঙ্গা বহুল ব্যাবহৃত হতো। এরপর কথা হয় ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকূপী গ্রামের মৎস্যজীবি আব্দুল কুদ্দুস খন্দকারের সাথে। সে নিজে ডোঙ্গা তৈরী করে এবং ডোঙ্গা দিয়ে সারা বছর বেগবতি নদি থেকে মাছ ধরে কালীগঞ্জ এবং নলডাঙ্গা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। ডোঙ্গা নির্মাতা হওয়ায় এলাকার মানুষ তার কাছে ডোঙ্গা তৈরীর বায়রা দিয়ে থাকেন। তার কাছ থেকে জানা যায়, তাল গাছের অধিক্যতার কারনে এই এলাকায় ডোঙ্গা নির্মান কাজ সহজ ছিলো, ডোঙ্গা তৈরীর কাজ করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতো।
নানা প্রতিবন্ধকতার কারনে তালের ডোঙ্গা নির্মাতারা হারিয়ে গেছে, সেই সাথে ডোঙ্গাও প্রায় হারিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের খুব কম জায়গায় ডোঙ্গা নির্মান হয়।
তালের ডোঙ্গা নির্মান সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুদ্দুস বলেন ১০-২০ বছর বয়সী একটা তাল গাছ থেকে দুটো তালের ডোঙ্গা নির্মান করা যায়। তালের ডোঙ্গার সামনের দিকটা অনেকটা বড় এবং গোল হয় পিছন দিকটা অনুপাতিক হারে অনেকটা গোল এবং কারুকাজ সম্পন্ন হয়। তিনি আরো বলেন তৎকালীন সময় একটা ডোঙ্গার দাম ছিলো ১০০ টাকা সর্বোচ্চ আর পুরো একটি তাল গাছ কেনা যেত সর্ব্বোচ্চ আশি টাকায়। আর এখন একটি তালের ডোঙ্গা তৈরী করতে সব মিলিয়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচা হয়। তিনি বলেন ভালো গাছের ডোঙ্গা ৮-১০ বছর অনাহাসে ব্যাবহার করা যায়। বর্ষা চলে গেলে ডোঙ্গা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়।
কুদ্দুস উপর মহলের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন ডোঙ্গা টিকিয়ে রাখতে নদি খনন করতে হবে। তালের ডোঙ্গা পরিবেশ বান্ধব ও সহজ নৌযান। এ ধরনের নৌযান টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি উদ্দ্যোগ প্রয়োজন।