ঝিনাইদহ সদর

মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নিয়ে মরতে চায় ঝিনাইদহের মোসলেম উদ্দীন

মাজেদ রেজা বাঁধন, ঝিনাইদহের চোখঃ

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরলেও ১৯৭১ এ বাংঙ্গালী জাতীর মুক্তির রনাঙ্গনে সম্যুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে মৃত্যুর দ্বার প্রান্ত থেকে ফিরে আসা ঝিনাইদহ সদরের কুমড়বাড়িয়া ইউনিয়নের ধুপাবিলা গ্রামের মৃত শহর আলী বিশ্বাসের ছেলে মোসলেম উদ্দীন। ৪৮ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাক্তি, সংস্থা এবং সরকারী দপ্তরে ধর্না ধরে ধরে আজ সে রোগে ও বয়সের ভারে ক্লান্ত। যার বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো সেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এর নিকট তার একমাত্র চাওয়া সে যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো তার স্বীকৃতি পাওয়া। স্বীকৃতির সংবাদ পেয়েই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চায়।

মোসলেম উদ্দীন ঝিনাইদহ সদরের ধুপাবিলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকার নিউ একাডেমি স্কুলে পড়া লেখাকালীন ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে মিছিলে যেতে যেতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজনীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে দীর্ঘ জীবন অতিবাহীত করেছেন। তিনি ১৯৬৮ সালে নিউ একাডেমি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। দারিদ্রতার কারনে আর পড়ালেখা সম্ভব হয়নি তাই চাকুরীর আশায় ১৯৬৯ সালে যশোর ঝুমঝুমপুর থেকে আনসার ট্রেনিং আন্ডার ইপিআর এ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্যে ঝিনাইদহ সরকারী কেসি কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধাদের প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা অবস্থায় একদিন রাত ১১টার দিকে বাঁশি দিয়ে ডেকে ৪০জনকে বেছে নিয়ে ট্রাকে করে সশস্ত্র অবস্থায় বিষযখালীতে নিয়ে যাওয়া হয় পাক সেনাবাহীনিদের প্রতিরোধ করার জন্যে। সেখানে তারা বাংকার খনন করে পাঁচ ঘন্টা অবস্থান করে কিন্তু পাক সেনারা না আসায় তাদেরকে রাতের অন্ধকারে আবার ট্রাকে করে কালিগঞ্জ থানায় নিয়ে গেলে ওসি সাহেব তাদেরকে দুলালামুন্দিয়ায় যেতে বলে। তারপর তাদেরকে কালিগঞ্জের দুলাল মুন্দিয়া নামক যায়গায় যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়।সামনা সামনি গুলাগুলি হয় তারসাথে পাকসেনারা মর্টার এবং সেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তাদের ভারী অস্ত্রের মুখে দাঁড়াতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধরা পিছু হটতে থাকে। পিছু হটার সময় তার পাশে থাকা একই গ্রামের তাইজেল পাক সেনাদের মর্টারের আঘাতে শহীদ হয় এবং মোসলেম উদ্দীন জ্ঞান হারায়। যখন সে জ্ঞান ফিরে পায় তখন সে কাঁটা তারের বেড়ায় বেষ্টিত ফসলী জমিতে পড়েছিলো। তখনও মর্টারের শব্দ হচ্ছিল হয়ত মর্টারের শব্দে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো। জীবন বাঁচানোর জন্য সে কাঁটা তারের ছোট ফাঁক দিয়ে বেরতে গিয়ে সে পিঠে ও পায়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়। শরীরের বিভিন্ন যায়গা থেকে রক্ত ঝরছিলো। এই অবস্থায় মুড়ি আখের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কোটচাঁদপুরের দিকে যেতে থাকে। আগের দিন থেকে না খেয়ে থাকা এবং রক্তাক্ত শরীরে ক্ষুধা এবং পিপাসায় অত্যন্ত দূবর্ল হয়ে পরে মোসলেম উদ্দীন। পথে একটি আমগাছে ছোট ছোট আম দেখতে পায় সেই আম চিবিয়ে খেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। কোটচাঁদপুর তালসার নামক যায়গায় আসলে হামিরহাটি গ্রামের মৃত হামিদ আলী বিশ্বাসের ছেলে তাজ উদ্দীন নামের আরেক সহযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। দুই মুক্তিযোদ্ধা এক সাথে একজনের বাড়িতে পানি খাওয়ার জন্য গেলে তারা পানতা ভাত খেতে দেয় সেটা খেয়ে শরীরে শক্তি আসলে আবার হাঁটতে শুরু করে। তাজ উদ্দীন বেশি দুর্বল থাকায় তার রাইফেলটি মোসলেম উদ্দীন নিয়ে যায়। গ্রামে পৌছেঁ সে প্রথমে তার ফুফুর বাড়িতে পানি খাওয়ার উদ্দেশে বসে তার ফুফু তাকে পানি খেতে দেয় সে ২/৩ জগ পানি একবারে খেয়ে নেয়। তার ফুফু তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছিলো। পরে সে তাজ উদ্দীনের অস্ত্রসহ নিজ বাড়িতে পৌঁছালে গ্রামের সবাই তাকে দেখতে আসে। তখন তার পরনে ছিলো খাকি প্যান্ট এবং সেন্ড্র গেঞ্জি। শরীর ক্ষত বিক্ষত। নোংরা ময়লা ও কাদা।
মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসা এই যোদ্ধাকে তার পরিবার আর তাকে যুদ্ধে যেতে দেয় নাই তাই তাকে আর বাকি যুদ্ধে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজ উদ্দীন এর আপন বড় ভাই মোঃ আলাউদ্দীন বলে আমার ছোটভাই তাজ উদ্দীন দুলালমুন্দিয়া যুদ্ধ শেষে ফিরে আসলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি তোর অস্ত্র কোথায় সে তখন বলে আমি খুব দুর্বল ছিলাম অস্ত্র বহন করতে পারছিলাম না তাই মোসলেম ভাইকে দিয়েছিলাম সে তার বাড়িতে নিয়ে গেছে। আমি দুই দিন পর যেয়ে মোসলেম উদ্দীনের নিকট যেয়ে আমার ভাইয়ের অস্ত্রটি চাওয়া মাত্রই সে মাটির গর্ত থেকে অস্ত্রটি এনে আমাকে দিয়ে দেয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে অস্ত্রটির ট্রিগার কিছুটা ভাঙ্গা ছিলো। সেই অস্ত্রটি আমি পরে জমা দিয়ে দেই। শুধু আমি কেন আমাদের এলাকার সবাই জানে মসলেম উদ্দীন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সে যখন যায় তখনও আমি জানি সে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে।

লেবুতলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন জানায় মোসলেম উদ্দীন ভাই আমার সাথে ঐদিন বিষযখালী ছিলো এবং সে আমাদের সাথে দুলালমুন্দিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। আমি তাকে যুদ্ধে অংশ নিতে দেখেছি।

ধুপাবিলা গ্রামের মৃত নেহার আলী মোল্যর ছেলে আমজাদ আলী মোল্যা জানায় মোসলেম উদ্দীন যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে খাকী প্যান্ট এবং স্যান্ডো গেঞ্জি পরে প্রথমে আমাদের বাড়িতে বসেছিলো আমার মা তাকে পানি খেতে দিয়েছিলো সে দুই জগ পানি একবারে খেয়েছিলো। আমার মা তাকে দেখে কান্নাকাটি করছিলো।

কুমড়োবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলে আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে আমি জানি মোসলেম উদ্দীন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলো এবং সেও তার পরিবার মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button