জানা-অজানানির্বাচন ও রাজনীতিপাঠকের কথা

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মূর্ত প্রতীক–নূরে আলম সিদ্দিকী

ঝিনাইদহের চোখঃ

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ শব্দ দুটি একটি অপরটির পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দীর্ঘ ২৩ বছরের ধারাবাহিক ও নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তিনি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। বাঙালির স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণের একক ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই রাজনৈতিক পথপরিক্রমণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। আমি অনেকবার বলেছি বঙ্গবন্ধুকে একটা গানের সঙ্গে তুলনা করলে তার কথা, সুর, স্বরলিপি হচ্ছে ছাত্রলীগ।

আজকের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি বারবার শুনেছে, তাদের মননশীলতা এবং বিশ্লেষণশক্তি আজ অতীব প্রগাঢ়। যারা যে দলমত আদর্শে চেতনায় বিশ্বাস করুক না কেন, আমার সঙ্গে প্রায় সবাই একমত হবেন ৭ই মার্চের ভাষণটি স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল।

শুধু শব্দচয়ন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সমর্থিত জুলফিকার আলী ভুট্টোর কূটকৌশল সম্পর্কে প্রখর ও তীক্ষ্ন দৃষ্টি বাংলাদেশের জনমতকে তো বিভ্রান্ত করতে পারেই না, বরং ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, ধনী-দরিদ্র সবাইকে একটি অদৃশ্য রাখীবন্ধনে আবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যালোকে অভিষিক্ত হওয়ার।

ভাষণের বিশ্লেষণে আমার প্রত্যয়দীপ্ত বিশ্বাসটিকে উন্মোচিত করার জন্য আমি একটি তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে (ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসার একদিন পর ১৭ই মার্চ) একজন বিদেশি সাংবাদিক (মার্ক টালি) প্রশ্ন করলেন, আপনাদের নেতা, যাকে আপনারা জাতির পিতা ঘোষণা করেছেন, তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে যে চারটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন সেই চারটি শর্ত পরিপূর্ণ মেনে নিলেও পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকে থাকে। বাংলাদেশ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পেলেও স্বাধীনতা তো অর্জিত হয় না। আপনারা তো স্বাধীনতার সুস্পষ্ট প্রত্যয় ও প্রতীতি ঘোষণা করে আন্দোলন করছেন। যদি ইয়াহিয়া খান চারটি প্রস্তাবই পরিপূর্ণভাবে মেনে নেন তখন আপনাদের অবস্থান কি হবে? আপনারা কি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অমান্য করে স্বাধীনতার দাবি অব্যাহত রাখবেন নাকি আন্দোলনের গতি স্তিমিত করে দেবেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে আমি উত্তর দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, অপেক্ষায় থাকুন। ইতিহাস প্রমাণ করবে। ভয়ভীতি, নির্যাতন-নিগ্রহের আতঙ্ক অথবা কোনো প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা ৭ই মার্চের প্রদত্ত স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান থেকে বঙ্গবন্ধুকে একবিন্দু নড়াতে পারবে না।

আমরা যে কর্মসূচি পালন করেছি, করছি এবং আগামীতেও করবো সেটি তারই নির্দেশে। আমরা তারই চিন্তায় শানিত, তারই চেতনার উত্তরাধিকারী। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এবং এখানে তিনি অনন্য সাধারণ, জনগণের নাড়ির স্পন্দন তিনি বুঝতে পারেন। তার আঙ্গিকেই তিনি কর্মসূচি দেবেন। ৭ই মার্চের ঘোষণাটি সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিন্তা চেতনা, প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ের অভিব্যক্তি। এই স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনে যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে আমরা মোকাবিলা করবো তারই নির্দেশে, ইঙ্গিতে এবং নেতৃত্বকে অনুসরণ করে।

৭ই মার্চ সকালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় চরম উত্তেজনা। এটা কোনো সংঘর্ষে রূপ লাভের উত্তেজনা ছিল না। উত্তেজনা ছিল বঙ্গবন্ধু আজ তার বক্তৃতায় কি বলবেন তা নিয়ে। জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীই স্বাধীনতার প্রত্যয়ে সুদৃঢ থাকলেও মূল রাজনীতির স্রোতধারায় তিনটি অভিমত তখনো কমবেশি সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল একটি ভাগ তখনো ধারণা পোষণ করতেন, ২৩ বছর পর সরকার গঠনের সুযোগ যখন পেয়েছি তখন সরকার গঠনের পর সমস্ত শোষণের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নিয়ে ওদেরকে আমরা নিজেরাই খোদা হাফেজ দিয়ে দেবো। এই চিন্তাটি উৎসারিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কাছ থেকে। তারই সহকর্মী এবং চেতনার উত্তরসূরি, বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেন এই ধারণাটির সরব প্রবক্তা ছিলেন। প্রবীণ ও রক্ষণশীল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব খুব সম্ভবত ক্ষমতার প্রলোভনের আঙ্গিকে নয়, প্রত্যয়ের অংশ হিসেবেই ওই কথাটি বিশ্বাস করতেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং তার ভাবাদর্শ ও চেতনার উত্তরসূরি সিরাজউদ্দিন হোসেনকে অনেকের সঙ্গে আমরাও সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং ভাবতাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চেতনার দার্শনিক।

আরেক দল যারা কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলনের সফলতার সৈকতে পৌঁছাতে পারে এই চেতনাটিতে বিশ্বাস করতেন না বরং ৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেট আদায়ের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চকিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলতেন। বলতেন, ‘ভোটের কথা বলে যারা, এহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘বাংলার অপর নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, প্রহসন, প্রহসন’। তারা চেয়েছিলেন, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু একতরফাভাবে জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তৃতীয়ত ছিলাম আমরা। যারা বন্দুকের নলকে শক্তির উৎস হিসেবে কোনোদিনই বিশ্বাস করিনি। আমরা আমাদের শক্তির উৎস হিসেবে পেন্টাগন, ক্রেমলিন অথবা দিল্লির দুর্গকে কোনোদিনই ভাবিনি। মানুষের বুকনিঃসৃত সমর্থনই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শক্তি মনে করেছি। মানুষের হৃদয়নিংড়ানো আশীর্বাদই আমাদের ৭০- এর নির্বাচনের স্বপক্ষে ম্যান্ডেট এনে দিতে পারবে- এই প্রত্যয়ে উজ্জীবিত ছিলাম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমাদের বিশ্বাসটি সগৌরবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু উল্লিখিত তিনটি শক্তিকেই অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্বাস ও প্রতীতির প্রতি তার আস্থা নিরঙ্কুশ ছিল। তার সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয়ের অনুরণন অনুরণিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা পূর্বকালে সকল ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখি বন্ধনে বাঁধতে পারলেন। এই তিন মতের সমর্থকরাই উপস্থিত ছিলেন ৩২ নম্বরে।

মানিক মিয়ার চিন্তার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বেশকিছু প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, ক্ষমতার পথ ব্যবহার করাই হচ্ছে বাংলার কল্যাণের এবং শোষণের প্রতিশোধের একমাত্র উপায়। জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি যাদের প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল অবিচল তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন জনাব সিরাজুল আলম খান। আমাদের চেতনার আঙ্গিকে যারা আমার অগ্রজ সর্বজনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সৈয়দ মাযাহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, আবদুর রউফ, বন্ধুবর তোফায়েল আহমেদ, বন্ধুবর কবি আল মুজাহিদী, বন্ধুবর খালেদ মাহমুদ আলী, স্নেহাস্পদ আবদুল কুদ্দুস মাখন, সৈয়দ রেজাউর রহমান, রাফিয়া আক্তার ডলি, মোস্তফা মোহসীন মিন্টু, কাজী ফিরোজ, এমএ রেজা, কে এম সাইফুদ্দিন, মফিজ, রাজিউদ্দিন আহমেদ, শেখ শহীদ, এমএ রশিদ প্রমুখ নেতারা ও লক্ষ লক্ষ নিবেদিত, উজ্জীবিত ও উৎসর্গিতপ্রাণ কর্মী বিশ্বাস করতেন স্বাধীনতাই শেষ লক্ষ্য।

যে অগণিত নাম এই ক্ষুদ্র কলেবরে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তারা বিশ্বাস করতেন, ম্যান্ডেটের পর আঘাত হানলে জীবনের বিনিময়ে হলেও শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রত্যাঘাতও করা হবে। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, ওদের কূটকৌশলগুলোকে বিবেচনায় রেখেই তীক্ষ্ন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বাধীনতার প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা না দিলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। ওরাও আমাদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এখানে আত্মপ্রচারের স্বার্থে নয় ইতিহাসের দায় মোচনের জন্যই বলতে হচ্ছে, আমাদের মতটির প্রতিনিধিত্ব আমাকেই করতে হতো। এটা অন্য কোনো কারণে নয়, আমার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আপত্য স্নেহ, কারাগারে দীর্ঘ ১৭ মাস তার একমাত্র সান্নিধ্যে তার মানসিকতাকে উপলব্ধি করার একটা বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধু সেদিন সবার কথাই ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন। সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) কখনোই মঞ্চে উঠতে চাইতেন না। সেদিনও ওঠেন নাই। এটিই তার ক্যারিশমা ও কিংবদন্তির মূল কারণ। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে শুধু ৭ই মার্চে কেন, সর্বক্ষেত্রেই নিজেকেই আড়াল করে পেছন থেকে সমস্ত আন্দোলনের উপাদান তৈরি করার বিষয়টি ছিল আমার কাছে লক্ষণীয়। আড়াল করে রাখা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নীল নকশা তৈরির সমন্বয়ে তিনি এক বিরল প্রতিভা ছিলেন।

সিরাজুল আলম খান মৌলিকভাবে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। নির্বাচনের প্রক্রিয়াতে নয়। তবুও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ তার জন্য শেষ কথা ছিল। তিনি নেহেলিষ্ট (নৈরাজ্যবাদী) ছিলেন। তিনি যেমন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু তার রক্তের কণায় কণায় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিন্তা। এই দুটি চেতনা পরস্পর সংঘর্ষিক হওয়ার কারণেই তিনি সাফল্যে পৌঁছতে পারেননি। এবং ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কথাটি উচ্চারণ না করা সত্ত্বেও তিনি বিদ্রোহ করেননি।

৩২ নম্বর থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আমরা চারজন, সিরাজুল আলম খান এবং খুব সম্ভবত তোফায়েল আহমেদ সাহেব একই গাড়িতে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই। আমরা মঞ্চে উঠে গেলাম (সিরাজ ভাই তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে মঞ্চে উঠেননি)। আমরা মাইকের দখল নিলাম। এই বিশাল জনসমুদ্রকে স্লোগানে স্লোগানে শুধু মুখরিত করিনি, মানুষকে উদ্বেলিত করেছি, উচ্ছ্বসিত করেছি। মানুষের প্রত্যয় ও প্রতীতিকে শানিত করেছি স্লোগান ও খণ্ড খণ্ড বক্তৃতার মধ্যদিয়ে। আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই, বঙ্গবন্ধু যখন ধীর পদক্ষেপে মঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে শুনিয়েই আমি রেসকোর্সের উদ্বেলিত জনতাকে বললাম, বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, তোমরা তো স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত; প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির মতো ভাস্বর। তোমাদের শক্তি কোথায়? সামর্থ্য কতটুকু। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বলেছি, আমাদের শক্তির উৎস এই উদ্বেলিত জনতা। একেই আমরা গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বালাবো। একেই আমরা আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত করে ওদের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে ছিন্ন ভিন্ন করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবো। তাকে দু’হাত তুলে দেখিয়ে বললাম, ওই যে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠছেন। তার নির্দেশে স্বাধীনতার জন্য বুকের শেষ রক্তবিন্দু প্রদান করতে আপনারা প্রস্তুত আছেন কিনা। সারা রেসকোর্স ময়দানভরা জনতা দু’হাত উত্তোলন করে বজ্রনির্ঘোষে গর্জে উঠলো ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধু ধীর পদক্ষেপে এসে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। তার ঐতিহাসিক ভাষণটি শুরু করলেন।

ভাষাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ- সবকিছু মিলে একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্ণ ঘোষণাই প্রদত্ত হয়েছিল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিতে। কিন্তু অতি সতর্কতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দচয়নের যে কুশলী পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাতে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। আমি তার নিজের প্রদত্ত শতাধিক ভাষণ নিজ কানে শোনার সৌভাগ্যের অধিকারী। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তো বটেই, নির্দেশ-নির্দেশনাকে উপলব্ধি ও মননশীলতায় পরিণত করার জন্য এবং তার বাগ্মিতাকে জ্ঞানপিপাসু ঋষিবালকের মতো অনুশীলন করার জন্য আমি একান্তচিত্তে তার বক্তৃতা শুধু শ্রবণ করিনি, অনুধাবন করেছি, উপলব্ধি করেছি, আত্মস্থ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালিয়েছি। সত্যতার খাতিরে এ বাধ্যবাধকতাকে স্বীকার করতেই হবে, তার নিজের প্রদত্ত কোনো ভাষণের তুলনা ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে হতে পারে না। তিনি তেজস্বী বক্তা ছিলেন, বাগ্মী ছিলেন। এটা অস্বীকার করা না গেলেও ৭ই মার্চে শব্দচয়ন থেকে শুরু করে তার প্রয়োগ এতই কার্যকর ছিল, ওই সভায় উপস্থিত সবার মন ও মননশীলতাকে প্রচণ্ড আবেগে শুধু অভিভূতই করে নাই, স্বাধীনতার চেতনাকে প্রত্যয় ও প্রতীতিতে পরিণতই করে নাই, বরং নিজ আঙ্গিকে সবাই এ প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরেছে যে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতার বক্ষবিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে। আমি সমস্ত উপলব্ধি ও সত্তায় আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আমার স্থির ধারণা, ৭ই মার্চে বাংলাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য আল্লাহর রহমতে তিনি উজ্জীবিত ছিলেন। ওই ভাষণটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপূর্ণ প্রত্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্ত জাতীয় চেতনাকে এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছিল।

ভাষণটি গোটা জাতিকে এমনভাবে উদ্বেলিত করেছিল যে, পৃথিবীর কোনো একক বক্তৃতায় এরূপ দৃষ্টান্ত আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই আবেগ আপ্লুত হৃদয়ে, অভিভূত চিত্তে ৭ই মার্চের ভাষণটিকে গ্যাটিসবার্গে আব্রাহাম লিঙ্কনের বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আমি এই তুলনাটি করতে নারাজ। কারণ দুটি বক্তৃতার প্রেক্ষাপট এবং আঙ্গিক ছিল ভিন্নতর। গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত আমেরিকার গৌরবদীপ্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিংকন ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন। সামাজিক দুর্যোগের মেঘ সরে গিয়ে যখন আমেরিকার পূর্ব দিগন্তে হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উদ্ভাসিত, তখন আমেরিকার বিজয়ী নেতা সারা বিশ্বের জন্য জগৎখ্যাত ভাষণটি দেন (Govt. of the people, by the people, for the people, can&_t perish from the earth.) কিন্তু ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপটটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে ঘন কালো মেঘে ঢাকা। একদিকে নিদারুণ অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বুক ভরা প্রত্যাশা। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস ও আকাঙ্ক্ষা তখন পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করার জন্য উদগ্রীব। বাংলার মানুষের এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই ৭ই মার্চের ভাষণটি প্রদত্ত। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, হরতাল, অসহযোগ, অবরোধের মধ্যদিয়ে অহিংস ধারাকে অব্যাহত রেখে চলছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। এর পূর্বে ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস ও সুশৃঙ্খলভাবে এবং নাশকতার সম্পর্কে সতর্ক থেকে আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান।

শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আমরাও সমস্ত সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করতাম, জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সংসদ স্থগিত ঘোষণা থেকে শুরু করে সামরিক জান্তার সহায়তায় যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন তাতে কোনো অবস্থাতেই ৬ দফাকে সংবিধানে সন্নিবেশিত হতে তিনি দেবেন না। কিন্তু আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অপপ্রচার করার উপকরণের জন্য তার এবং সামরিক জান্তার তীক্ষ্ন দৃষ্টি ছিল যাতে পৃথিবীর কাছে একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই ভাষণটি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে ১. তিনি যখন ৪টি শর্ত জুড়ে দিলেন ইয়াহিয়া খানের সামনে তখন ভুট্টোর কূটকৌশল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ২. তিনি যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের বললেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। তখন বিশ্ব জনমত উপলব্ধি করলো ৬ দফাভিত্তিক একটি সম্মানজনক সমঝোতায় উত্তরণে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই।

দ্বিতীয়ত, যারা ’৭০-এর নির্বাচনকেও অস্বীকার করে কোনো ম্যান্ডেটপ্রাপ্তির আগেই সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিতে চেয়েছিল, অতি বিপ্লবের প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির এ অংশটি চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স থেকে জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একতরফা ঘোষণা দান করবেন। তাদের অবাস্তব দুরাশা পূরণ না করে বঙ্গবন্ধ প্রখর থেকে প্রখরতর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থিদের যে অংশটি এ অভিলাষও ব্যক্ত করেছিল যে, পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যখন আমরা পেয়েছি, তখন ক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতেই হবে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা ২৩ বছরের নির্মম শোষণের শুধু প্রতিশোধই নেবো না, জৌলকারের মতো তারা যে বুকের তাজা রক্ত চুষে নিয়েছে, বিন্দু বিন্দু করে তার হিসাব আদায় করে নেবো। হয়তো তাদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিল, ১৯৫৪ সালে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই (অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না)।

চতুর্থত, আমরা নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বিপ্লবের বিরোধিতা করে ’৭০-এর নির্বাচনে স্বাধীনতার ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। ক্রমাগত বঙ্গবন্ধুকে এই চেতনায় উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি যে, এ ম্যান্ডেটটিকে স্বাধীনতা অর্জনের অমোঘ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আঘাত হানলে আমরা প্রত্যাঘাত হানবো। আক্রমণ করলে প্রতি-আক্রমণ চালাবো। ওদের অস্ত্র এবং ষড়যন্ত্রের শক্তি যত প্রখর ও প্রকট হোক না কেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যয়, প্রতীতি, বিশ্বাস, সাহস এবং সমর্থনকে আপনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দিবালোকের মতো সত্যে পরিণত হয়েছে আমাদের সেই প্রত্যয়। সভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করলেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, বাংলাকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ! প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে তার অকুতোভয় উচ্চারণ, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। প্রতি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমি ক্ষমতা চাই না, আমি বাংলার মানুষের মুক্তি চাই। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।

ভাষণটি শুধু সাধারণ বাঙালিদেরই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও এমনভাবে উজ্জীবিত করেছিল যে, ৭০’র নির্বাচনে অংশ না নেয়া মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও বঙ্গবন্ধুর ওপর অকৃত্রিম আস্থা রাখলেন। তিনি ১১ই মার্চ পল্টন ময়দানে এবং ১৭ই মার্চ রংপুরের জনসভায় বললেন, ‘আমার মুজিবরকে অবিশ্বাস করিও না। তাহার নেতৃত্বেই দেশ ও জাতি মুক্ত হইবে।’ তিনি ইয়াহিয়া খানকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘টালবাহানা ছাড়ো। আমার মুজিবের দাবি মানিয়া লও।’ এনডিএফ-এর নেতা মরহুম নুরুল আমীন সাহেব ১০ তারিখের গোলটেবিল অস্বীকার করে বললেন, শর্তহীনভাবে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। ওলি খান, এয়ার মার্শাল আজগর খান, বাকী বেলুচসহ আরো অনেক পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাও শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের তীব্র দাবি উপস্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও ভুট্টোর সামরিক জান্তার শক্তি অনেকখানি দুর্বল হয়েছিল। এটাও ৭ই মার্চের একটা বিশেষ অর্জন।

নতুন প্রজন্ম আমাকে প্রশ্ন করতে পারে, সেই সশস্ত্র সংগ্রামে তো আপনারা যেতে বাধ্য হলেন, তাহলে ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন কেন? ঐতিহাসিক বাস্তবতার আঙ্গিকে আমি পুনরায় উল্লেখ করতে চাই, পাকিস্তানের বর্বরোচিত সামরিক জান্তার শক্তির উৎস ছিল অস্ত্র ও অর্থ। তাদের চলার পথের বাহন ছিল ষড়যন্ত্র। আর আমাদের শক্তির উৎস ছিল বাংলার জনগণ। যে কৃষক গ্রীষ্মের ঘোরতর রৌদ্রে হালচাষ করে; লাঙল চালায়, তার বুক ভেজা ঘামের গন্ধে, যে মা মাঝ রাত্রে উঠে ধান সিদ্ধ করে; ঢেঁকিতে দাঁড়িয়ে পাড় দেয়; নকশি কাঁথায় ফুল তোলে, গ্রামের যে উদ্ধত যৌবনের মূর্তপ্রতীক তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে সর্বস্তরের উপার্জনের অবলম্বনে ব্যাপৃত, যে শিল্পী আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলার প্রকৃতির ছবি আঁকে; একটি ভেজা কাকের মধ্যদিয়ে রূপসী বাংলার চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যে কবি লিখে- পাথরের পর পাথর সাজাই/লিখে যাই নাম/সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম, যে শিক্ষক জ্ঞান দানের মাঝে মাঝে হৃদয়ের বিস্তৃত ক্যানভাসে স্বাধীনতার বিমূর্ত ছবিটি দেখে উদ্বেলিত হয়, যে ছাত্র এক সাগর রক্তের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার সৈকতে পৌঁছাতে শপথ গ্রহণ করে, এদেশের কামার-কুমার, মাঝি-মাল্লা, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের বুকনিঃসৃত আশীর্বাদই আমাদের শক্তির উৎস বলে বারবার আমি উদ্ধৃত করতাম।

আমরা অবহিত ছিলাম, তারা অস্ত্র আনছে, সংগঠিত হচ্ছে, চট্টগ্রামে অস্ত্র খালাস হচ্ছে। জয়দেবপুরে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। কিন্তু আমরা আস্তে আস্তে একেকটি অবরোধ, অসহযোগ, হরতালের কর্মসূচি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় জনগণকে সংগঠিত করতে পেরেছিলাম বলেই ২৫শে মার্চের পৈশাচিক আক্রমণে মানুষ অকুতোভয়ে একযোগে মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস পেয়েছিল। বাঙালি জাতির সমস্ত স্তরের মানুষ- ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, জনতা, সৈনিক, পুলিশ রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে গিয়ে একটি মিলনের মোহনায় একত্রিত হতে পেরেছিল। ফলে এই নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার মতো বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমরা প্রজ্বলিত করতে পেরেছিলাম মুক্তিকামী জনতার ঐক্যের দাবানল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অপপ্রচারই সেই ঐক্যে চির ধরাতে পারেনি। বিশ্বজনমতকেও বিভ্রান্ত করতে পারেনি।সূত্র: মানবজমিন।

লেখক: স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক, চার খলিফার জ্যেষ্ঠ ও প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক।

পূর্বপশ্চিমবিডি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button