ঝিনাইদহে ৪৯ বছরে ৩৪ হাজার ৭৪০ জনের আত্মহত্যা
কামরুজ্জামান লিটন, ঝিনাইদহের চোখঃ
আত্মহত্যা কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না ঝিনাইদহে। প্রতি বছর পরিসংখ্যানের খাতা ভারি হচ্ছে। বাড়ছে পরিবারে শোকের মিছিল। তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। বিচারপতি, চিকিৎসক, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা থেকে সাধারণ মানুষ এই পথে পা বাড়াচ্ছেন।
জেলায় আত্মহত্যার হার পুরুষ -৪২% ও নারী-৫৮% জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরে হরমন জনিত সমস্যা, কীটনাশকের সহজলভ্যতা, আত্মহত্যার ঘটনা শুনে প্রভাবিত হওয়া, অতিরিক্ত আবেগ প্রবণতা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও জীবন-যাপনের কষ্ট থেকে মানুষ আত্মহত্যার পথে পা বাড়াচ্ছে মানুষ।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলায় স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪৯ বছরে ৩৪ হাজার ৭৪০ নর-নারী আত্মহত্যা করেছেন। এ সময় অন্তত ৬৫ হাজার নর-নারী আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে গেছেন। ঝিনাইদহের পুলিশ বিভাগ, বিভিন্ন হাসপাতাল ও আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর ভল্যুন্টারি অ্যাকটিভিটিস (শোভা) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে আত্মহত্যার চরম ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে ঝিনাইদহ পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এ জেলায় বিপুল সংখ্যক নর-নারী বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে আত্মহত্যা করেছেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালের পর আত্মহত্যার চেষ্টাকারী বৃদ্ধি পেলেও উন্নত চিকিৎসা ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কিছুটা কমে এসেছে।
ঝিনাইদহ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যার কোনো রেকর্ড না থাকলেও এ সময়ে অপমৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক ১৭ হাজার বলে মনে করা হয়। কারণ হিসেবে চিকিৎসক ও পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, সে সময় চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত।
ফলে, আত্মহননকারীদের দ্রুত চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ঝিনাইদহের ৬টি থানায় পুলিশের রেকর্ডকৃত অপমৃত্যু মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে ৭৪২, ১৯৮৯ সালে ৭৪৫, ১৯৯০ সালে ৮০৯, ১৯৯১ সালে ৮৮৫, ১৯৯২ সালে ৭৯৪, ১৯৯৩ সালে ৯০১, ১৯৯৪ সালে ৭০৭, ১৯৯৫ সালে ৭২৫, ১৯৯৬ সালে ৮০৮, ১৯৯৭ সালে ৭১৩, ১৯৯৮ সালে ৭৯০, ১৯৯৯ সালে ৭১২, ২০০০ সালে ৬৫৭, ২০০১ সালে ৫৯৭, ২০০২ সালে ৭৮০, ২০০৩ সালে ৭২০, ২০০৪ সালে ৬৭০, ২০০৫ সালে ৫৫০, ২০০৬ সালে ৪২৯, ২০০৭ সালে ৪০১, ২০০৮ সালে ২২৬, ২০০৯ সালে ২২১, ২০১০ সালে ৩১৬ এবং ২০১১ সালে ৩০০ জন, ২০১২ সালে ২২৫ জন, ২০১৩ সালে ৩১১ জন, ২০১৪ সালে ৩০৩ জন, ২০১৫ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৮৮ জন, ২০১৭ সালে ৪২৪ জন, ২০১৮ সালে ৩৯৬ জন এবং গেল বিদায়ী বছর ২০১৯ সালে ৩৩৪ জন আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করা এনজিও ‘শোভার’ পরামর্শক জাহিদুল ইসলাম জানান, তাদের সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা ও দক্ষতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিস্তিতির উন্নতি হলেও জিরো টরারেন্স অর্জন সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, পারিবারিক কলহ নিরসন ও হতাশাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেই আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসতে পারে।
আত্মহত্যার কারণ নিয়ে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করা সংবাদ কর্মীদের ভাষ্যমতে, আত্মহত্যা ঝিনাইদহ জেলার জন্য একটি অভিশাপ! ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলায় গড়ে ১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু উন্নত চিকিৎসা ও ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ হার এখন কমে আসছে।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা কেগম জানান, ঝিনাইদহ অঞ্চলে আত্মহত্যার প্রবণতা এমনিতেই একটু বেশি। হতে পারে, এ অঞ্চলের মানুষ বেশি আবেগপ্রবণ। তবে পারিবারিক সমস্যা, সংসারে অশান্তি, প্রেমঘটিত ব্যাপারই বেশি কাজ করে থাকে।
ঝিনাইদহ শহরের প্রাকটিশনার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল ফাত্তাহ জানান, শরীরে কিছু হরমোন আছে, যা মানুষের ক্রোধ, হাসি, কান্না ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে রকম একটি হরমোন ‘থাইরক্সিন’। থাইরয়েড গ্লান্ট থেকে এ হরমোন তৈরি হয়। অনেক সময় হরমোন বৃদ্ধি ও হ্রাসজনিত কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। হরমোন পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো সম্ভব বলে মত দেন এই চিকিৎসক। এদিকে আত্মহত্যা নিয়ে নতুন ভাবে কাজ শুরু করেছে মাদার তেরেসা ব্লাড ব্যাংক নামে একটি সংগঠন। আত্মহত্যা রোধে বছরব্যাপী সচেতন মূলক প্রচারণা কার্যক্রম শুরু করেছে সংগঠনটি। ইতিমধ্যে ঝিনাইদহ শহরের পুরাতন ডিসি কোর্ট চত্বরে মুক্তমঞ্চ থেকে এই প্রচারণা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক জনাব সরোজ কুমার নাথ।
এ সময় ঝিনাইদহ জেলা কালচারাল অফিসার জসিম উদ্দিন, মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান আরতি দত্ত, অংকুর নাট্য একাডেমির সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন জুলিয়াস, মাদার তেঁরেসা ব্লাড ব্যাংকের সভাপতি এস.এম রবি, সাধারণ সম্পাদক আসিফ উল ইসলাম পাপ্পু, সিনিয়র সহ-সভাপতি তারেক মাহমুদ জয় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।