কালীগঞ্জজানা-অজানাটপ লিডদেখা-অদেখা

ঝিনাইদহের বাড়িতে-বাড়ীতে গৃহিনীদের কুমড়া বড়ি উৎসব

সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ

রাতে প্রচন্ড শীত এবং দিনের বেলার কড়া রোদে কুমড়া বড়ি জব্বর স্বাদের হয়। কিন্ত বড়ি দেয়ার দিন বর্ষা হলে আর বিপদের শেষ নেই। কুমড়ার বড়ি তরকারীতে দিলে তার স্বাদই পাল্টে যায়। তাই শীত আসলেই এ এলাকার গৃহনীরা এ বড়ি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বৃহত্তর যশোর এলাকার জন্য কুমড়া বড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। কুমড়া আর এক প্রকারের কলাই একসাথে পিসে তৈরী করা হয় এক প্রকারের মন্ড। যা কোন পাত্রে ছোট ছোট আকারের করে সারিবদ্ধ ভাবে বসিয়ে রোদে শুকানো হয়। এরপর ঘরে সংরক্ষন করে তরকারীতে দিয়ে সারাবছর খাওয়া হয়। বিভিন্ন এলাকায় এটার নাম ভিন্ন হলেও এ এলাকায় এর নাম কুমড়া বড়ি। শীত আসলেই বাড়ি বাড়িতে চলে বড়ির উৎসব।

গৃহিনীরা জানান, বর্ষা মৌসুমে গ্রামের প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারেই বড়ি দেয়ার উদ্দেশ্যে লাগানো হয় চাল কুমড়া। এ কুমড়ার জালি তরকারী হিসাবে খাওয়া হয়। আর কিছু কুমড়া বড়ি দিতে রেখে দেয়া হয়। শীতের আগমনের সাথে সাথে এ কুমড়াগুলো গাছ থেকে ছিড়ে নতুন কলাই উঠলে কলাই আর কুমড়া পিসে বড়ি দেয়া হয়।

বয়োবৃদ্ধ সাজু বিবি জানান, এক সময় বড়ি দেয়াটা বেশ কঠিন কাজ ছিল। কেননা এখন মেশিনে কুমড়া আর কলাইয়ের মন্ড তৈরী করা হলেও আগে ছিল বেশ কঠিন কাজ। কারন তখন প্রচন্ড শীতের রাতে সারারাত তুঁর তুর করে কাঁপতে কাঁপতে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে মন্ড তৈরী করতে হতো। তিনি আরও বলেন, চাল কুমড়া সাধারনত শীতের শুরুতেই বড়ি দেয়ার উপযোগী হয়। এ কুমড়ার সাথে কলাইয়ের ডাল পিসে কাপড় অথবা বিশেষ নেটে ছোট ছোট বড়ি করে রোদে শুকালেই খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। এটাই তরকারীর মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুক্ষন জ্বলন্ত চুলায় রাখলে বড়িগুলো স্দ্ধি হয়ে যায়। এরপর তরকারী বা সবজি হয়ে ওঠে আরও সুস্বাদু। শীত মৌসুমের দেওয়া বড়ি সংরক্ষণ করে সারাবছর খাওয়া হয়। এ এলাকার সকল পরিবারেই এ বড়ি দিয়ে থাকে। একদিকে নিজেরা রাখেন অন্যদিকে আত্বীয় স্বজনদের জন্যও পাঠিয়ে থাকেন।

কালীগঞ্জের ফয়লা গ্রামের গৃহিণী ফাতেমা বেগম জানান, সারাদেশে এ কুমড়া বড়ি চলে কিনা তিনি জানেন না। তবে শীত আসলেই এ অঞ্চলের গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের পরিবারগুলোতে এ কুমড়ার বড়ি দেয়ার কাজ চলে। এ যেন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কুমড়া বড়ির উৎসব। এর আগে প্রতিটি কৃষক পরিবারে বর্ষা মৌসুমে বসতবাড়ির আশপাশ ও ঘরের পাশে কুমড়ার চারা লাগিয়ে দেন। গাছগুলো লতিয়ে গেলে উঠিয়ে দেয়া হয় বসবাসের ঘর,গোয়ালঘর, রান্নাঘরের ছাদ অথবা চালে, কোন কোন ক্ষেত্রে মাচং করে এ গাছের লতাগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়। কোন প্রকার সার ছাড়াই এখানে আপন গতিতে লতিয়ে বেড়ে উঠে এক সময় কুমড়ার ফুল ও ফল আসতে শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে কাঁচা বা জালি কুমড়া তরকারী অথবা ভাজি করে খাওয়া হয়। বাকিগুলো রেখে দেয়া হয় বড়ি দেওয়ার জন্য। কুমড়াগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে ছাদে অথবা টাল বা মাচংয়ে ঝুলতে থাকে। এক পর্যায়ে কুমড়া পেকে এর গায়ে সাদা গুড়া পড়ে যায়। সাথে সাথে গাছের তরতাজা ভাব কেটে গিয়ে এক পর্যায়ে গাছও মারা যায়। তখন গৃহিণীরা কুমড়াগুলো ঘরে রেখে সংরক্ষণ করে শীতের জন্য অপেক্ষা করেন। পরে ক্ষেতের নতুন এক জাতের কলাই উঠলে বড়ি দেয়া শুরু হয়। প্রথমে ডাল পানিতে ভিজিয়ে রেখে রসালো করতে হয়। পরে কলাইয়ের উপরের কালো ছাল তুলে ফেলা হয়। এরপর কুমড়া কেটে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। এরপর এ দুটি এক সাথে মিশিয়ে মেশিনে অথবা ঢেঁকিতে পিসে মন্ডাকার করা হয়। এরপর বাড়িতে এনে পাত্রে ফেলে হাত দিয়ে উত্তমরুপে মাখানো হয়। এক পর্যায়ে আঠালো হয়ে উঠলে নেট, টিন, চালুনী, পরিষ্কার কাপড়ে ছোট ছোট বড়ি আকারে দিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এরপর এটা হয় তরকারীতে খাওয়ার উপযোগী বড়ি।

কালীগঞ্জ পৌর এলাকার কাশিপুর গ্রামের গৃহিণী দোলনচাঁপা জানান, শীত মৌসুমে কুমড়ার বড়ি দেয়াটা সকল পরিবারের মহিলারা একটা উৎসব বলে মনে করে। কেননা প্রতিটি পরিবারেই এটার জন্য পূর্ব প্রস্ততি থাকে।

মস্তবাপুর গ্রামের গৃহিনী মনোয়ারা বেগম জানান,আবহমান কাল থেকেই এ এলাকার মানুষ কুমড়া বড়িতে ভক্ত। তবে এটা তৈরীতে পূর্বের চেয়ে কষ্ট কমে গেছে। কেননা পূর্বে এ ডাল পিসা হতো ঢেঁকিতে। কিন্ত বর্তমানে যন্ত্র নির্ভর সময়ে এটা মেশিনে করা হচ্ছে। আর গ্রাম এলাকায় এখন ঢেঁকিও নেই। ফলে শীতে রাত জেগে ঢেঁকিতে আর পাড় দিতে হয় না। উপজেলার খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের মমতাজ বেগম জানান, এ বছর তিনি প্রতিকেজি ১০০ টাকা দরে কলাইয়ের ডাল ও ৩’শ টাকা দিয়ে ৩ টি কুমড়া কিনে বড়ি দিয়েছেন। অর্ধেকটা পরিবারের জন্য রেখে বাকিটা শহরে বসবাসরত মেয়ে-জামাইদের জন্য পাঠিয়েছেন। তিনি জানান, বড়ি ভালোমত শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে সারাবছর খাওয়া যায়। মাছ না থাকলেও তরকারী বা সবজিতে বড়ি দিলে স্বাদ হয় লোভনীয়।

গ্রামের এক গৃহিণী জানান, শীত মৌসুমে কুমড়া বড়ি দেয়া সব গৃহিণীদের জন্য যেন একটা রুটিন মাফিক কাজ। এ বড়ি নিয়ে গ্রাম্য সমাজে রয়েছে নানা কুসংস্কার। কেউ বড়ি দিলে ওইদিন যদি কুয়াশায় সূর্যের দেখা না মেলে তাহলে অনেকে বলে থাকেন বড়ি দেয়া গৃহিনীর কারনে সূর্য়ের দেখা মিলছেনা। যদিও এ কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই।

কালীগঞ্জ শহরের মাছবাজার সংলগ্ন সুশান্ত ষ্টোরের সত্বাধিকারী সুশান্ত ভট্রাচার্য্য জানান, তিনি দোকানে সব জিনিসের সাথে সারাবছর সব ধরনের ডালও বিক্রি করে থাকেন। তবে শীত শুরু হলে বড়ি দেয়া কলাই বিক্রিতে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। আবহাওয়াগত কারনে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর কলাইয়ের ডাল বেশি বিক্রি হচ্ছে। এখন প্রতিকেজি ডাল এখন ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন। গত এক সপ্তাহে তিনি মোট ২৭ মন ডালের বড়ি বিক্রি করেছেন। এভাবে যতদিন শীত থাকবে ততদিন চলবে বলে যোগ করেন এ মুদিব্যবসায়ী।

সাবজাল হোসেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button