ঝিনাইদহের জয়বাংলা বাজারটি আজো অবহেলিত
ঝিনাইদহের চোখঃ
চারিদিকে যুদ্ধ চলছে, গ্রামের মানুষ গুলো ভয়ে গ্রাম থেকে বের হতে পারছেন না। পাশ^বর্তী বাজার গুলোও বেশ দূরে। বাড়িতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসেরও অভাব চলছে। এই পরিস্থিতিতে কয়েকজন যুবক দুই গ্রামের মাঝে বসিয়ে নিলেন কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এটিছিল ১৯৭১ সালের মাঝা মাঝি সময়ের গল্প।
গ্রামের সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কেনাবেচা হতো আর রেডিও’র মাধ্যমে এলাকার মানুষকে যুদ্ধের খবর শোনানো হতো। শত্রু পক্ষের পরাজয়, নিজের দেশের যোদ্ধাদের জয়ের খবর শুনে আন্দলিত হতেন আর জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে মানুষ গুলো বাড়ি ফিরতেন। এই জয়বাংলা শ্লোগান থেকেই গ্রামের ছোট বাজারটি’র নাম হয়েছে জয়বাংলা বাজার। যেটি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার দিঘলগ্রাম ও পিড়াগাতী গ্রামের মাঝে অবস্থিত।
বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও জয়বাংলা বাজারটির তেমন উন্নতি হয়নি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে সামান্য, বাজারে নেই কোনো চাদনি। নেই একটা যাত্রী ছাউনি।
বাজারের মাঝ দিয়ে যাওয়া একমাত্র ঝিনাইদহ-শৈলকুপা ভায়া জয়বাংলা বাজার সড়কটির ঝিনাইদহ অংশ এখনও ইট বিছানো। যার উপরদিয়ে ছোট-বড় যানবাহন চলাচল করতে খুবই কষ্ট হয়। ব্যবসায়ীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিজড়িত বাজারটি একটি সুন্দর বাজার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে ওই বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে ছোট-বড় ৪০ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চায়ের দোকান গুলোতে মানুষের ভীড়, সবাই চা পান করছেন আর দেশের নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছেন। বিকালের চপ-পিয়াজু তেলে ভাজার কাজ চলছে। মুখোরচক এই খাবার খাচ্ছেন অনেকে। দোকানের সামনে দাড়াতেই দোকানীর প্রশ্ন ভাইকি দেবো। পাশ থেকে একজন বললেন ভাই মনে হয় চা খেতে দাড়িয়েছেন। বাজারে বসেই কথা হয় পিড়াগাতী গ্রামের লুঃফর রহমান এর সঙ্গে। তিনি বিল থেকে ধরে কিছু মাছ নিয়ে বসে আছেন। তিনি বললেন, আজ সাপ্তাহিক বাজার না হওয়ায় লোকজন কম। শুক্র আর মঙ্গলবার সাপ্তাহিক বাজারের দিন আসলে দেখা যেতো কতটা দোকান বসেছে আর কত মানুষ কেনা বেচা করছেন।
জয়বাংলা বাজার এর নামকরণ কিভাবে লুঃফর রহমান এর কাছে এই প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, এতোদিন কেউ বাজারটির নাম নিয়ে কোনো খোঁজ নেয়নি, আজ অন্তত কেউ খোজনিচ্ছেন। তিনি বলেন, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার শেষ গ্রাম পিড়াগাতী আর দিঘলগ্রাম। পাশাপাশি দুইটি গ্রামের পরেই রয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চাপড়ি গ্রাম। দুই উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ায় তারা সব সময় থাকেন অবহেলিত। তাদের দুইগ্রামের পূর্বে বাকড়ি, পশ্চিমে ভাটই, উত্তরে শেখরা আর দক্ষিণে মধুপুর বাজার রয়েছে।
লুৎফর রহমান আরো জানান, ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তাদের দুই গ্রামের চারিপাশে শত্রæপক্ষ ঘোরাঘূরি করতে থাকে। গ্রামের মানুষ গুলো ভয়ে বাইরে বের হতে পারেনা। বাড়িতেও তেল-লবন, ঝাল-মসলার অভাব পড়ে যায়। তখন উপায় না দেখে গ্রামের মাঝে ফাঁকা একটি স্থানে তারা ৩ জন তিনটি মুদি দোকান বসিয়ে নেন। গোপনে ঝিনাইদহ শহর থেকে মালামাল ক্রয় করে এনে এখানে বিক্রি করতেন। লুৎফর রহমান ছাড়াও ছিলেন বাবরআলী বিশ্বাস ও ইন্তাজ আলী মোল্লা। লুৎফর রহমান এই দোকান বসানোর পূর্বে গ্রামে গ্রামে গামালকরে তেল-লবন বিক্রি করতেন। অন্যরা এলাকার মানুষের প্রয়োজনে দোকান বসিয়ে ছিলেন।
পিড়াগাতী গ্রামের রমজান আলী শেখ জানান, যুদ্ধের সময় দুই গ্রামের মানুষ বাইরে যেতে পারতেন না। যুদ্ধের খবর নিতে বিকাল হলেই বাবর আলীর দোকানে ভীড় করতেন। সেখানে রেডিও’তে খবর শোনার ব্যবস্থা ছিল। খবরে দেশের ছেলেদের জয় আর শত্রæদের পরাজয় শুনে জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে করতে অনেকেই বাড়ি ফিরতেন। এ সময়গ্রামে একে অপরকে খোজ করলেই সকলেই বলে দিতেন জয়বাংলা বাজারে যেতে। এখান থেকেই বাজারটির নামকরণ হয়েছে জয়বাংলা বাজার। আজো বাজারটি ওই নামেই পরিচিত।
বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মেজবাউজ্জামান কল্লোল জানান, বাজারটি জয়বাংলা নামেই পরিচিত এবং বাইরে থেকে এই নাম বললেই যে কেউ বাজারটির অবস্থান বলে দেবেন।
তিনি বলেন, বাজারটির সঙ্গে স্বাধীনতার যোগ সুত্র রয়েছে, তারপরও তেমন উন্নত হয়নি। বাজারের সঙ্গে একটি মাদ্রাসা রয়েছে, আছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যেটি আজো এমপিও ভুক্ত হয়নি।
তিনি বাজারটি সরকারের আওতায় নিয়ে উন্নয়ন হবে আশা করেন।
এ বিষয়ে স্থানিয় নিত্যানন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃফারুক হোসেন বিশ্বাস এর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, বাজারটি’র নামের একটা গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু তেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েনা ওঠায় সরকারের রাজস্ব ভুক্ত হয়নি। তারপরও কিছু উন্নয়ন হয়েছে এবং সম্প্রতি কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। তারা এখন আশা করছেন এটি রাজস্ব খাতে নিয়ে উন্নয়ন করা হবে। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে কিছু উন্নয়ন করা হয়েছে বলে জানান। তিনি আরোবলেন, বাজারে বাজার চাঁদনি আর যাত্রী ছাউনীর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এগুলো নির্মানে যে পরিমান বরাদ্ধ প্রয়োজন তানা পাওয়ায় এখনও করা সম্ভব হয়নি। জয়বাংলা শ্লোগান মানুষের মাঝে ধ্বনিত হবে এই প্রত্যাশায় বাজারটির উন্নয়নে সরকারের দৃষ্টি কামনা করেছেন।