মহেশপুর ভবনগরে বাড়ীতে বাড়ীতে দৃষ্টিনন্দন ধানের গোলা
ঝিনাইদহের চোখঃ
প্রচলিত আছে ‘পুকুর ভরা মাছ, আর গোলা ভরা ধান’। গ্রামাঞ্চলের এই প্রচলিত কথাটির পুকুর ভরা মাছ দেখা গেলেও এখন আর গোলা ভরা ধান পাওয়া যায় না। কৃষকরা গোলায় ধান রাখে না, গোলার পরিবর্তে বস্তায় ভরে গুদামজাত করেন। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা গোলা কি কাজে ব্যবহার হয় সেটাও ভুলতে বসেছেন।
ঠিক সেই সময় ঝিনাইদহ মহেশপুরের ভবনগর গ্রামে পাড়ায়-পাড়ায়, বাড়িতে-বাড়িতে ধানের গোলা দেখতে পাওয়া গেছে। গ্রামের কৃষকরা বলছেন, তারা এখনও অনেকে গোলায় ধান রাখেন, আবার অনেকের গোলা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যেগুলো তারা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন। তাদের গ্রামে এখনও অর্ধশত বাড়িতে গোলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসি।
সরেজমিনে মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের ভবনগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ধানের গোলা রয়েছে। একই স্থানে পাশাপাশি একাধিক গোলা আছে। গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে চারটি গোলা রয়েছে যার মালিক গ্রামেরই আমির হোসেন তরফদার। এর একটু পাশে ঝন্টু মন্ডলের বাড়িতে রয়েছে আরেকটি গোলা। একটু দুরে আমজাদ তরফদারের বাড়িতে রয়েছে আরো দুইটি গোলা। আরেক পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় সেখানেও একাধিক বাড়িতে ধানের গোলা। গ্রামের বাসিন্দা ঝন্টু মন্ডল জানান, তাদের গ্রামে এখনও অর্ধশত বাড়িতে ধানের গোলা রয়েছে। ইতিপূর্বে সব গোলায় ধান রাখা হতো। কিন্তু এখন ধানের চাষ কম হওয়ায় অনেক পড়ে আছে। অবশ্য কয়েকজন আছেন যারা এখনও গোলা ব্যবহার করেন, তারা গোলায় ধান রাখেন।
ঝন্টু মন্ডল জানান, গ্রামের আবুল কাশেম, আসমত আলী, শুকুর আলী, আব্দুল কাদের, নাসির উদ্দিন, রমজান আলী, আমির হোসেন তরফদার, আকুল খাঁ, রিপন মিয়া, আজগর আলী, মমিনুর রহমান, মহসিন আলী, লাল্টু মোল্লা, মিনারুল ইসলাম, মজনুর রহমান, আবু তাহের, সিরাজুল ইসলাম, ফজলুর রহমান মোল্লা, জামান মিয়াসহ কমপক্ষে ৫০ টি বাড়িতে ধানের গোলা রয়েছে। এগুলো বাঁশ দিয়ে তৈরী। উপরের ছাউনীটি অনেকে খড় ব্যবহার করেন আবার অনেকে টিন ব্যবহার করেন। এভাবে তারা গোলা তৈরী করেন।
ভবনগর গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, একটি গোলা তৈরী করতে কৃষকের খরচ হয় ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত। যেগুলোতে ১৫০ থেকে ২৫০ মন ধান রাখা যায়। গোলায় ধান রাখলে ভালো থাকে বলে জানান এই কৃষক। তিনি আরো জানান, ভবনগর গ্রামে ৫ শতাধিক পরিবার বসবাস করেন। লোকসংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। এই গ্রামের কৃষকরা চারটি মাঠে জমি চাষ করে থাকেন। মাঠগুলোতে ২ হাজার চাষযোগ্য জমি রয়েছে। যার মধ্যে ইতিপূর্বে ১২ শত বিঘা ধানের চাষ হতো, বাকিটা অনান্য ফসল চাষ করতেন কৃষকরা। বর্তমানে এই ধাস চাষ কমে ৪ শত বিঘায় দাড়িয়েছে। যে কারনে গোলার ব্যবহার কমে গেছে। তিনি নিজেও ধান গোলায় রাখতেন, এখন আর রাখেন না। তার গোলাটি পড়ে আছে বলে জানান। ঝন্টু মন্ডল জানান, তিনিও ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি করতে হয়, যে কারনে গোলার প্রয়োজন হয় না। তবে বাড়িতে গোলা আছে।
আরেক কৃষক শাহাজ উদ্দিন জানান, ১৯৭৭ সালের পর তাদের গ্রামে ব্যাপকহারে ধান চাষ শুরু হয়। এরপর গ্রামের মানুষ ধান রাখতে গোলা তৈরী শুরু করেন। সেই থেকে গোলার প্রচলন রয়েছে। তবে বর্তমানে কৃষক ধানের সঠিক মুর্য না পাওয়ায় ঘরে ধান রাখতে পারছেন না। বাকিতে সার-ঔষধ ক্রয় করে ধান ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ধানের গোলার ব্যবহার কমে যাওয়ার এটাও একটি কারন বলে জানান ওই কৃষক।
স্থানিয় শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, ভবনগর গ্রামের বাসিন্দা হারুন-অর রশিদ জানান, কৃষকরা এখনও গোলায় ধান রাখতে আগ্রহী। কিন্তু উৎপাদন খরচ মিটিয়ে ধান সংরক্ষণ করা তাদের জন্য কষ্টকর। তারপরও অনেকে গোলায় ধান রাখেন। বস্তার চেয়ে গোলায় ধান রাখলে ধান ভালো থাকে। তিনি বলেন, তাদের গ্রামের মানুষের মধ্যে গোলার ব্যবহার এখনও রয়েছে। কিন্তু ধান চাষ কমে যাওয়া ও ধান কাটা মৌসুমেই ধান বিক্রি হয়ে যাওয়ায় এই প্রচলন কমে যাচ্ছে। তারপরও স্মৃতি হিসেবে তারা অনেকে বাড়ির আঙ্গিনায় গোলা সংরক্ষণ করছেন। আর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আমানুল্লাহ জানান, গোলায় ধান রাখা কৃষকের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষক ধান উৎপাদন কলে লাভবান হলে আবার মাঠে ধানের চাষ বৃদ্ধি পাবে, পাড়ায় পাড়ায় গোলা ভরা ধান পাওয়া যাবে।