ধর্ম ও জীবন

আবু বাকরা (রা.)

ঝিনাইদহের চোখঃ

নোফায় বিন হারেস বিন কালাদা সাকাফি (রা.)। তার উপনাম আবু বাকরা। আরবিতে ‘বাকরা’ অর্থ নাটাই বা নাটাইয়ে প্যাঁচানো রশি। ‘আবু বাকরা’ মানে নাটাইওয়ালা। তিনি ছিলেন তায়েফের সাকাফ গোত্রের অধিবাসী। তার মা সুমাইয়া ছিলেন হারেস বিন কালাদার ক্রীতদাসী। নবীজির তায়েফ অবরোধের সময় আবু বাকরা দুর্গের ভেতর অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তখন নাটাইয়ের একটি রশিতে ঝুলে তায়েফের দুর্গপ্রাচীর ডিঙিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। পরে এসে নবী (সা.) এর হাতে মুসলমান হয়েছেন। সাহাবিদের মধ্যে তার ফতোয়া দেওয়ার অধিকার ছিল। তিনি মুফতি, ফকিহ ও মুজতাহিদ ছিলেন। ছিলেন সম্ভ্রান্ত, সম্মানিত, সম্পদশালী ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী।

ইসলামের সাম্যবিধান সবার জন্য সমান। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-মূর্খ, পদবিধারী কারও জন্য এখানে বিশেষ ছাড় নেই। কোরআন ঘোষণা করেছে, চারজন সাক্ষী ছাড়া ব্যভিচারের নির্দিষ্ট শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না। সাক্ষীসংখ্যা চারের কম হলে তা কারও কাছে প্রকাশ করাও জঘন্য অপবাদ বলে গণ্য হবে। এজন্য ৮০ বেত্রাঘাত শাস্তির ঘোষণা আছে।

ঘটনাক্রমে আবু বাকরাসহ তিনজন এমনই ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি কাউকে ব্যভিচার করতে স্বচক্ষে দেখেছিলেন। সাক্ষী ছিল মাত্র তিনজন; চারজন নয়। কিন্তু তিনি নিজের মতে অটল থাকার কারণে খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.) তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। কারণ, এ অপরাধ প্রমাণ করতে তিনজনের সাক্ষ্য যথেষ্ট নয়। ইসলামের বিধানে মিথ্যা সাক্ষ্য বা মিথ্যাবাদীর সাক্ষ্য গ্রহণীয় নয়।

তার ছোট ছেলে আবদুল আজিজ বলেছেন, আবু বাকরা ওলাসা সম্প্রদায়ের এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন। তার এই সৎমায়ের মৃত্যু হলে সৎমামারা জানাজা পড়ানো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তখন আবু বাকরা বলেছিলেন, আমি তার স্বামী হিসেবে জানাজা পড়ানোর বেশি যোগ্য। এ কথা বলে তিনি জানাজা পড়িয়ে যখন দাফনের জন্য কবরে অবতরণ করলেন, তারা হিংসা প্রকাশ করে এত জোরে তাকে ধাক্কা মেরে কবরের মধ্যে ফেলে দিল যে, তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। বস্তুত, আত্মপ্রীতি ও হিংসাত্মক মনোবৃত্তি মানুষকে অন্ধ ও বধির করে ছাড়ে।

সবাই তাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে গেল। তার ২০ জন ছেলেমেয়ে ছিল। তাকে জড়িয়ে ধরে সবাই কান্না আরম্ভ করল। একপর্যায়ে তার জ্ঞান ফিরল। তিনি বললেন, তোমরা আমার জন্য কেঁদো না। আল্লাহর শপথ, অন্য যে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু অপেক্ষা আমার কাছে নিজের মৃত্যু অধিক পছন্দনীয়। তার ছেলেমেয়েরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমি এমন যুগের আশঙ্কা করছি, যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা যাবে না। আসলে ওই যুগে কোনো কল্যাণের আশা করা যায় না। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ১২২০৯)।

তিনি মানবধিকার বিষয়ে এতই সচেতন ছিলেন যে, কেউ জোর করে একটা কাঠের টুকরো এনে বসরার মসজিদের কোনো কাজে লাগিয়েছিল। যতদিন ওই টুকরোটি ছিল, তিনি অন্যত্রে নামাজ পড়েছেন। তিনি নবীজির সূত্রে বলেছেন, দুজন মুসলমান গোলমাল করে কেউ কাউকে হত্যা করলে ওই খুনি ও নিহত ব্যক্তি দুজনই জাহান্নামে যাবে। কারণ তারা দুজনই একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল।
আবু বাকরা (রা.) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, মৃত্যুরোগ প্রকট আকার ধারণ করল, তিনি বললেন, আমার পক্ষ থেকে অসিয়তনামা লেখ। লেখক লিখল, ‘এটা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গী আবু বাকরার অসিয়ত।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কি মৃত্যুর সময় আমাকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছ? ‘সঙ্গী’ শব্দটি মুছে ফেল। তুমি বরং লেখ ‘এটা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর গোলাম আবু বাকরার অসিয়ত।’ তুমি লেখ ‘আবু বাকরা সাক্ষ্য দিচ্ছে, আল্লাহ তার প্রভু। মুহাম্মদ (সা.) তার নবী। ইসলাম তার ধর্ম। কাবা তার কেবলা।’

আল্লাহর কাছে আবু বাকরার প্রত্যাশা অন্যান্য তাওহিদপন্থির প্রত্যাশার মতো, তার প্রভুত্বকে স্বীকারকারীর মতো, তার প্রতিশ্রুতি ও ধমকিকে বিশ্বাসকারীর মতো, তার আজাব ও প্রতিশোধকে ভয়কারীর মতো, তার রহমতের একজন ভিখারির মতো। নিশ্চয়ই তিনি সবচেয়ে বড় দয়াবান। ছেলেরা চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আনার অনুমতি চাইল। তিনি অনুমতি দিলেন না। যখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো, যন্ত্রণা বাড়তে থাকল, তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘কোথায় তোমাদের ডাক্তার, যদি পারে, সত্যবাদী হয়ে থাকে, তাহলে দেহের ভেতর রুহ ফিরিয়ে দিক। আল্লাহর কসম, দুনিয়ার সব ডাক্তার মিলেও একজনের রুহ ফিরিয়ে দিতে পারবে না।’
ছেলেরা বলল, এখন ডাক্তার কোনো কাজে আসবে না।

তিনি বললেন, আগে এলেও ডাক্তার কিছু করতে পারত না।
এমন সময় তার মেয়ে আমাতুল্লাহ এসে কাঁদতে লাগল।
তিনি বললেন, বেটি, আমার জন্য কেঁদো না।

আমাতুল্লাহ : আপনার জন্য কাঁদব না তো কার জন্য কাঁদব?
তিনি বললেন, তুমি কেঁদো না। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণ নেই যা বেরিয়ে যাওয়া আমার নিজের প্রাণের চেয়ে উত্তম হবে। এমনকি উড়ন্ত মশা-মাছির প্রাণও নয়। মানে আমি মরে যাওয়া উত্তম মনে করছি। এরপর তিনি ওসমান (রা.) এর ক্রীতদাস তার পাশে বসা হুমরানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে বলব কী, কেন আমি বেঁচে থাকা নিরাপদ মনে করছি না? কারণ, সময়ের পালাবদলে আমি শঙ্কিত যে, না জানি কখন কোন বাধা এসে আমার ও ইসলামের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়!
৬৭১ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৫১ হিজরিতে তিনি বসরায় ইন্তেকাল করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৫/৪, তাহজিবুল কামাল : ৩০/৮, তারিখে বাগদাদ : ১০/৪৮)।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button