টিপু সুলতান, ঝিনাইদহের চোখ-
করোনা সংকটকালে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা যাত্রা শিল্প ও শিল্পীদের টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অতীতে এই শিল্পের যে বিত্তবৈভব ছিল, তা এখন ¤্রয়িমাণ। মঞ্চে মেকআপ করা রঙিন মানুষগুলোর অবস্থা বাস্তবে ঠিক তার বিপরীত। তার ওপর করোনা যেন মহাসংকটে ফেলেছে এ অঙ্গনের মানুষদের। এ পেশায় টিকে থাকতে পারবেন কি না, সেটাই ভাবছেন যাত্রার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা। এই সময়ে করোনার কারণে একেবারেই ক্ষতির মুখে পড়বে এ শিল্প। এটা পুষিয়ে ওঠা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত যাত্রা সংশ্লিষ্টজনেরা। করোনার এ ধাক্কায় একেবারেই তাঁদের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ যাত্রা মালিক সমিতির আহবায়ক ও চৈতুলী অপেরা`র স্বত্বাধিকারী কুতুবুল আলম শাহীন মনে করেন, দেশে যাত্রাশিল্পের দর্শক কমে যাওয়ায় এ শিল্পের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে শোচনীয়। এখন করোনার কারণে ধুঁকতে থাকা এ শিল্প একেবারেই বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। তিনি আরো বলেন, ‘যাত্রাশিল্পের এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে শোচনীয় অবস্থা, এর মধ্যে আবার কিছু অসাধু মানুষ যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য দেখিয়ে ভালো শিল্পীদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের বিরুপ চেহারায় এখন মনে হচ্ছে হাল ছেড়ে দিতে হবে। কবে করোনা ভালো হবে, কবে মানুষের সমাগম হবে, কবে যাত্রা করার অনুমতি পাব, এগুলো নিয়ে বড় চিন্তায় আছি। একটি যাত্রাদলে যন্ত্রশিল্পী, মেকআপম্যান, অভিনয়শিল্পী মিলে প্রায় ৪০ জন, কোনো কোনো দলে তারও বেশি মানুষ কাজ করেন। তাঁদের প্রায় সবাই এই যাত্রার ওপরই নির্ভরশীল। করোনায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা সবাই বেকার। করোনা ভালো হওয়ার লক্ষণ না দেখে কিছু যাত্রাশিল্পী পেশা বদল করেছেন। আবার কেউ কেউ সুদিনের আশায় অপেক্ষা করছেন। যাত্রা ছাড়া অন্য কিছু আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। এখন কীভাবে চলব, কোনো উপায়ই দেখছি না। খেয়েপরে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
চৈতুলী অপেরার অভিনেতা ইবাদত হোসেন, হাসেম মুন্সি, শাহাদৎ হোসেন, রিজিয়া খাতুন, অঞ্জু ঘোষ সহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার শুরু থেকে তারা কাজ হারিয়ে পড়েছেন বিপাকে। জীবিকার তাগিদে তারা কেউ কেউ সবজির ব্যবসা, রিকশা চালানো, দিনমজুর, সাইকেল মেকারির কাজ সহ বিভিন্ন নি¤œমানের কাজ করে কোনোরকমে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন ।
তারা আরো জানান, আগে নিয়মিত অনুশীলনে মুখর থাকত চৈতুলী অপেরার টিনের ঘরটি। দিনরাত কাটত যাত্রার অনুশীলনে। এই ঘরে রাখা যাত্রার পোশাক, ঢোল-তবলায় জমতে শুরু করেছে ধুলাবালু। এই অপেরার নায়ক চরিত্রের অভিনেতা সেলিম রেজা বলেন, ‘আমাদের শৈলকুপা উপজেলায় প্রায় ৪৫ জন এ পেশার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের প্রায় ৯৯ ভাগই ভালো নেই। ধারদেনায় আমরা জর্জরিত। সরকার আমাদের সহযোগিতা না করলে হয়তো এই পেশাতেই আর থাকতে পারব না।
শৈলকুপা উপজেলা যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি তাহাজুদ্দিন মেম্বর জানান, কয়েক বছর ধরে যাত্রাশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তার অস্তিত একেবারে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। আগে থেকেই বিপর্যস্ত এ শিল্পকে এখন একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে করোনা। নাটক-চলচ্চিত্র সব মাধ্যমে ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু বিকল্প হিসেবে তাঁরা ফেসবুক, অনলাইনে লাইভ করছেন। অনেকে শুটিং করছেন। কিন্তু যাত্রাশিল্পীদের সেই সুযোগ নেই। কীভাবে শত শত যাত্রাশিল্পী চলছেন নাগরিক জীবনে, এটার কেউ খোঁজখবর রাখে না। উপজেলায় ৪৫ জনের মতো যাত্রাশিল্পী আছে। তাদের খোঁজখবর কিংবা কোন সাহায্য সহযোগিতা করেনি কেউ। কিছুদিন আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মমকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের নিকট সাহায্যের দরখস্ত দিয়েছিলাম। তিনি আশ^াসও দিয়েছিলেন, তবে তার কোন ফল আমরা পাইনি। তাই এ শিল্প ও শিল্পীদের বাঁচানোর জন্য নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন।