মহাত্মা লালন মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বিরল দার্শনিক/আজ ১৩০ তম তিরোধান দিবস
ঝিনাইদহের চোখ-
মনিষী ও লৌকিক ধর্মাচার প্রতিষ্ঠার পুরোধা পুরুষ ছিলেন বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই। আজ ১৭ অক্টোবর মহামতি লালন সাঁইজির ১৩০তম তিরোধান দিবস। লালন সাঁই বিশ্ব মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বিরলপ্রজ পথিকৃৎ। মানবতার এই আধ্যাত্মিক সাধক একাধারে ফকির (বাঙালি মুসলমান সাধক), দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। গান্ধীজিরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। তাঁর গানে ফুটে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বলিষ্ঠতা।
মহামতি লালন সাঁইজি একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক ছাড়াও বাউল সম্প্রদায়ের গুরু। মানবতাবাদী এই মনিষীর জন্ম ও ধর্ম নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। লালন গবেষকদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, ১৭৭৪ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের ভাঁড়রা গ্রামে আবার কোনো কোনো গবেষকের মতে, ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামের অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে মানবতাবাদী বিস্ময়কর প্রতিভা লালন ফকিরের জন্ম।
আবার এ দুটি মতের সঙ্গেও কারো কারো ভিন্নমত রয়েছে। ফকির লালন সাঁই নিজে তাঁর জন্ম, ধর্ম, জাত-কুল সম্পর্কে কখনো কিছু বলে যাননি। তবে তিনি তাঁর গানে বলেছেন, ‘‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, ফকির লালন কয় জাতের কিরূপ আমি দেখলাম না দুই নজরে” আবার আরেকটি গানে তিনি বলেছেন ‘‘এমন সমাজ কবে-গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে’’।
তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে যা বলতে চেয়েছেন – আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, ১৭৯০ সালে তীর্থ ভ্রমণে বেড়িয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন লালন। সঙ্গী সাথিরা একপর্যায়ে তাঁকে মৃত ভেবে নদীতে ভেলায় ভাসিয়ে দেন। ভেলা ভাসতে ভাসতে কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে কালীগঙ্গা নদীর তীরে আটকে যায়।
এ সময় নদীতে জল আনতে গিয়ে ছেঁউড়িয়া গ্রামের মতিজান বিবি ভেলায় তীরে আটকে থাকা মৃতপ্রায় লালনকে দেখতে পেয়ে তাৎক্ষণিক তাঁর স্বামী মলম শাহকে বিষয়টি বলেন। তখন মলম শাহ দ্রুত নদী থেকে তুলে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন লালনকে। এরপর দীর্ঘ সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন লালন। প্রসঙ্গত, মতিজান বিবি ও মলম শাহ দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। পরবর্তীতে লালন তাদের পালক সন্তান হিসেবে ছেঁউড়িয়াতেই আমৃত্যু বসবাস করেন।
এখানেই চলতে থাকে তাঁর সাধন ভজন। সাধনার মধ্যদিয়ে তিনি মানবতাবাদ, দেহতত্ত্ব ও পারমার্থিক চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে লালন সাই বা সাঁইজিতে পরিণত হন। লালনের দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে পালক পিতা-মাতা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ভক্ত ও পালক পিতা মলম শাহের দানকৃত জমিতে ১৮২৩ সালে লালন সাঁইজি ছেঁউড়িয়ায় গড়ে তোলেন আখড়াবাড়ি। সেসময় লালন দর্শন ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সরাসরি লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
ভক্তদের কাছে লালনের গান শুধু সুরে বসানো শব্দমালা নয়। তাদের কাছে লালনের গান জীবন-জিজ্ঞাসার অন্বেষণ। ভক্ত-শিষ্য অনুসারীদের নিয়ে ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে ফাল্গুনের দোল পূর্ণিমায় লালন সাঁই সাধন ভজনের মধ্য দিয়ে দোল উৎসব উদযাপন করতেন। ছেঁউড়িয়ায় বসবাসের একশ বছর পর ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর পহেলা কার্তিক আখড়াবাড়িতেই ভক্ত-শিষ্যদের উপস্থিতিতে মহামতি ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন।
ছেঁউড়িয়া লালন আখড়া বাড়ির মূল আঙিনায় ফকির লালন সাঁইজিসহ তাঁর সরাসরি শিষ্য ও ভক্তদের ৩২টি সমাধি রয়েছে। মূল মাজারে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ফকির লালন সাঁই ও তাঁর পালক মাতা মতিজান ফকিরানী। মূল মাজার আঙিনায় অপর ৩০টি সমাধির মধ্যে সরাসরি সাঁইজির শিষ্যরা হলেন মলম শাহ, বিশখা ফকিরানী, শীতল শাহ, জাগো শাহ তাঁর নানী ও স্ত্রী, ভোলাই শাহ, পিয়ারী নেছা ফকিরানী, কামিনী ফকিরানী, মনিরদ্দিন শাহ, পাঁচি রাণী ফকিরাণী, মানিক শাহ ও তার স্ত্রী।
তিরোধানের পর থেকে ভক্তরা লালন সাঁইজির তিরোধান দিবস জাঁক-জমকপূর্ণভাবে পালন করেন। দীর্ঘ দিন ধরে লালন একাডেমির তত্বাবধানে ছেঁউড়িয়ায় বছরে দুটি উৎসব উদযাপন করা হয়। ফাল্গুনের তিথিতে দোল উৎসব আর পহেলা কার্তিক লালনের তিরোধান দিবস। উৎসব দুটি লালন ভক্ত শিষ্য অনুসারির পাশাপাশি লাখো জনতার মিলন মেলায় পরিণত হয়। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে ভক্তরা আসেন ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে। আসেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও।
প্রতিবারের মতো এবারও উৎসবকে ঘিরে বসেছে গ্রামীণ মেলা। সশরীরে লালন নেই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি-সৃজন চিরন্তন বাণী হয়ে ঘুরে ফিরছে অগণিত ভক্ত-অনুসারির মাঝে। অনবদ্য সেসব গীতি-কথন কালের স্রোতে শক্তি জোগায় মানবতা মুক্তির উত্তাল শ্লোগান হয়ে।