কালীগঞ্জজানা-অজানাটপ লিড

কালীগঞ্জের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা মহাবিপাকে/দরকার সরকারী পৃষ্টপোষকতা

সাবজাল হোসেন, ষ্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহের চোখ-

এক সময়ের অভাববেষ্টিত গ্রামটিতে আজ সব কিছুতেই শহুরে ছাপ। গড়ে উঠেছে নানা ডিজাইনের ব্যয়বহুল আলিশান ঘরবাড়ি। আর এটা সম্ভব হয়েছে গ্রামটি থেকে এক হাজারের বেশি কর্মক্ষম মানুষ প্রবাসে রয়েছেন। তাদের পাঠানো টাকায় পাল্টিয়েছে গ্রামটির অতীত চিত্র। শুধু নিজেদের গ্রামই নয়। তাদের অর্জিত রেমিট্যান্স দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। কিন্ত বিশ্বব্যাপি মহামারী করোনার থাবায় সেই গ্রামটিতে আজ হতাশার ছাপ পড়েছে। কেননা ছুটিতে বাড়ি আসা প্রায় শতাধিক রেমিট্যান্স যোদ্ধা ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আর কর্মস্থলে যেতে পারছেন না।

এদিকে তাদের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসার মেয়াদও অনেকের শেষ হয়ে গেছে। কর্মস্থলের কোম্পানীর নিকট পাওনা টাকাও রয়েছে অনেকের। অথচ বাড়িতে বসে কেউ কেউ মোবাইল ম্যাসেজে চাকরী হারানোর চিঠি পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা দানা বাধতে শুরু করেছে। এমন অবস্থা বিরাজ করছে প্রবাসী অধ্যুষিত ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের দামোদরপুর গ্রামে। ছুটিতে আসা প্রবাসীরা তাদের পাওনা বুঝে পেতে রি এন্ট্রি ভিসার (৩ মাসের ভিসা) ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

সরেজমিনে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর গ্রামটিতে গেলে দেখা যায়, গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠেছে রঙ বেরঙের বসতবাড়ি। বাড়িগুলো রঙ ও নকশায় শহরের বাড়িগুলোকে হার মানিয়েছে। গ্রামের সকল দিক দিয়েই যেন তাদের একেবারে শিখরে অবস্থান। তবে করোনার আগে ছুটিতে আসা প্রবাসীরা শোনালেন হতাশার গল্প।

কালীগঞ্জ উপজেলা পরিসংখ্যান ও নির্বাচন অফিসসূত্রে জানাগেছে, আজ থেকে ৯ বছর আগে গত ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী দামোদরপুর গ্রামের মোট জনসংখ্যা ছিল তিন হাজার নয়শ ছিয়ানব্বই জন। এরমধ্যে পুরুষ এক হাজার নয়শ আটত্রিশ জন আর মহিলা দুই হাজার আটান্ন জন।
একই বছরের ভোটার তালিকা অনুযায়ী এ গ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা দুই হাজার নয়শ তিতাল্লিশ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক হাজার চারশ একাশি জন। আর মহিলা ভোটার সংখ্যা এক হাজার চারশ বাষট্্ির জন।

ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য জাফর ইকবাল জানান,এক সময়ে তাদের গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যদের দিন কেটেছে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে। বসবাস করতেন মাটির অথবা বেড়ার তৈরী ঝুঁপড়ি ঘরে। কিন্ত প্রবাসীদের টাকায় আজ প্রতিটি পরিবারে আকর্ষনীয় দালান ঘর নির্মিত হয়েছে। তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে একদিনের জ্বরাজীর্ণ এ গ্রামটি। কিন্ত এখন ওই গ্রামের প্রবাসীরা আশা -নিরাশার দোলায় দুলছেন।

ওই গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আলহাজ্ব আক্কাচ আলী জানান,এ উপজেলার মধ্যে তিনিই প্রথম ১৯৮০ সালে লিবিয়াতে গিয়েছিলেন। পরে ১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে সৌদি আরব যান। এ থেকেই শুরু। পরে গ্রামের মসলেম উদ্দীন, ইসমাইল হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজনকে তিনি নিয়ে যান। তবে এ কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন গ্রামের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম।

ওই গ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি দিন প্রবাসে জীবন কাটানো সুলতান আহম্মেদ জানান, তিনি ১৯৮৬ সালে মালেয়েশিয়াতে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ মাত্র ৮ মাস আগে একাধারে প্রায় ৩৪ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে একবারে চলে এসেছেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ বাড়িতে এসে গ্রামের উন্নতিতে নিজেও অবাক হয়েছেন। সুলতান আহম্মেদের ভাষ্য, তাদের যৌথ পরিবারে মোট কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা ছিল ১১ জন। তাদের মধ্যে এক সময়ে মোট ১০ জন ছিলেন প্রবাসে। এমন অবস্থা সারা গ্রামেই।

কিন্ত নিরাশার গল্প শোনালেন ওই গ্রামের খোরশেদ আলম,সাড়ে ৪ বছর আগে তিনি কাতারে গিয়েছিলেন। প্রায় ৯ মাস আগে ছুটিতে বাড়িতে এসে আর যেতে পারেননি। কর্মস্থানের কোম্পানীতে তিনি বাংলাদেশী প্রায় ৮ লাখ টাকা পাবেন। এখন মালিকপক্ষ মোবাইল ফোনও রিসিভ করছেন না। পরিশ্রমের মাধ্যমে ওই দেশের কোম্পানীতে জমানো টাকা পাওয়া নিয়ে পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

মালয়েশিয়া প্রবাসী শামছুল আলম জানান, ১১ বছর মালেয়েশিয়ায় ছিলেন। ছুটিতে বাড়ি এসে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এখন আর যেতে পারছেন না। কোম্পানীতে বাংলাদেশী সমমানের প্রায় ১২ লাখ টাকা পাবেন। এদিকে ভিসা পাসপোর্টের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। তার মত এমন জটিলতায় পড়েছেন ছুটিতে আসা দেশের অনেক প্রবাসীই। এখন সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের এ পাওনা টাকা উদ্ধারের কোন পথ নেই।

সাইদুর রহমান জানান, তিনি দুবাইতে ছিলেন। ছুটিতে বাড়ি এসে আর যেতে পারেননি। আশা ছিল তার করনা পরিস্থিতি একটু সাভাবিক হলে যেতে পারবেন। কিন্ত কোম্পানীর পক্ষ থেকে কয়েকদিন আগে মোবাইল ম্যাসেঞ্জারে ক্যানসেল লেটার পাঠানো হয়েছে। ফলে সব আশা শেষ হয়ে গেছে। তিনি হতাশাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কোম্পানীতে আড়াই লাখ টাকা পাবেন। ব্যাংক একাউন্টও ওই দেশে। সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া ওই টাকাও পাবেন না।

এই গ্রামের অনেকেই পড়েছেন এমন ঝামেলায়। তাদের দাবি, অনেক দেশে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে। আবার অনেক দেশে নতুন করে লকডাউন দেয়া হয়েছে । পরিস্থিতি যাই হোক সরকারীভাবে উদ্যোগ নিয়ে তাদের জন্য রি এন্ট্রি ভিসার (৩ মাসের জন্য) ব্যবস্থা করলে তারা কর্মস্থলের দেশে গিয়ে পাওনাদি বুঝে পেতে পারেন।

ওই গ্রামের বাসিন্দা সাবেক চেয়ারম্যান ডাঃ নুরুল ইসলাম ও সমাজসেবক হারুন অর রশিদ মোল্ল্যা জানান, তাদের গ্রামের ১ হাজারেরও অধিক মানুষ প্রবাসে। সব মানুষই পরষ্পরে বন্ধু ভাবাপন্ন। তাই তারা গ্রামের উন্নয়নে এবং সামাজিক কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গেলে সাধ্যমত বিদেশ থেকেই খরচের টাকা পাঠিয়ে দিতে কার্পন্য করেন না। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারনে যারা ২০ বছর আগে গ্রামটি দেখেছেন তারা এখন গ্রাম দেখে চিনতে পারেন না।
কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন মোল্ল্যা জানান, তার ইউনিয়নের মধ্যে দামোদরপুর এক গ্রাম নিয়েই একটি ওয়ার্ড। এ গ্রাম থেকেই এক হাজারের অধিক মানুষ বিদেশে আছে। উন্নতিতে সারাদেশের মধ্যে এ গ্রামটি বেশ ব্যতিক্রমী। প্রবাসীরা ছুটিতে এসে অনেকে যেতে পারছেন না। আবার কর্মস্থলে তাদের পাওনাও রয়েছে। সব মিলিয়ে এখন তারা চরম হতাশার মধ্যে আছেন।

ঝিনাইদহ জেলা কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সবিতা রানী মজুমদার জানান, দামোদরপুর গ্রাম থেকে অনেক কর্মক্ষম মানুষ প্রবাসে আছেন। ছুটিতে এসে অনেকে যেতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে সবই ঠিক হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসীদের পাওনাদীসহ সকল বিষয় নিয়ে তারা ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু করেছেন। ক্ষতিগ্রস্থরা প্রয়োজনে ঋন নিয়ে এদেশেও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কিছু করতে পারবেন। কাজেই হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button