জানা-অজানাঝিনাইদহ সদরদেখা-অদেখা

ঝিনাইদহে সিনেমা হল হালচাল-১৮টির মধ্যে ১৬টিই বন্ধ!

ঝিনাইদহের চোখ-
এক সময় মানুষের জীবনে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে সিনেমা হলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিলো সিনেমা।

দেশের মানুষের বিনোদন যোগাতে নির্মিত হয় অসংখ্য সিনেমা হল। একটা সময় ছিল বিনোদন প্রেমীরা নতুন কোনো ছবি সিনেমা হলে আসলেই দেখতে ভিড় করতো। কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে ব্যর্থ হলে ব্ল্যাকে বিক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কিনে সিনেমা দেখতেন। অনেক সময় হল হাউজফুল হয়ে যেত তখন অতিরিক্ত চেয়ার দেওয়া হত।

কিন্ত আধুনিক যুগে ওই সময়টা এখন স্বপ্ন বললেই চলে। ঝিনাইদহের এক সময়ের জমজমাট ও জেলার সবচেয়ে পুরনো ছবিঘর সিনেমা হল ভেঙে সেখানে বহুতল মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন মালিকরা। আর চান্দা সিনেমা হল বন্ধ করে গড়ে ওঠেছে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন গাড়ির পার্কিং করার স্থান। অপরদিকে ঝিনাইদহ শহরের কবি সুকান্ত সড়কে অবস্থিত বর্তমানে ঝিনাইদহের একমাত্র প্রিয়া সিনেমা হলের প্রদর্শনী চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আর এভাবেই ঝিনাইদহ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র।

গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বিনোদন প্রেমীরা ঝিনাইদহে তেমন কোনো সিনেমা হল না থাকার কারণে বিভিন্ন পার্ক, রিসোর্ট সেন্টারগুলোকে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। প্রধান ধর্মীয় উৎসবসহ সপ্তাহিক ছুটির দিনে বিনোদন প্রেমীরা ভিড় করছে পার্ক, রিসোর্ট সেন্টারে।

ঝিনাইদহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লাইন ম্যান আমির হোসেন, শৈলকূপা উপজেলার ভাটই বাজার এলাকার অটো (ইজিবাইক) চালক আজাদ মিয়াসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝিনাইদহের সিনেমা হল গুলোতে এক সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিনেমা দেখতে ভিড় করতো। একটি সিনেমা সপ্তাহে দুই থেকে তিনবারও দেখতেন তারা।

জেলা তথ্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহ সদরে পাঁচটি সিনেমা হলের মধ্যে রয়েছে ‘ছবিঘর’ ‘প্রিয়া’ ‘চান্দা’ হাটগোপালপুরের ‘হ্যাপি’ ও ডাকবাংলা বাজারের ‘স্বর্ণালী’। হরিণাকুন্ডু উপজেলায়- ‘গোধূলী, ‘মল্লিকা, ‘মৌসুমি, ‘প্রিয়াংকা’ ‘রংমহল’সহ ছয়টি। শৈলকুপা উপজেলায়- ‘নুপুর’ ও ‘কিছুক্ষণ’। কালীগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ‘শ্রীলক্সী’ ও ‘ছন্দা’। মহেশপুর উপজেলায় রয়েছে ‘বিউটি’ ও ‘দুলারী’। এছাড়া কোটচাঁদপুর উপজেলায় এক মাত্র ‘লাভলী’ সিনেমা হল।

সদর উপজেলায় পাঁচটি সিনেমা হলের চারটিই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে ঝিনাইদহ শহরে প্রিয়া ও কালীগঞ্জে ছন্দা নামে আরেকটি সিনেমা হল কোনো প্রকারে টিকে আছে। করোনার জন্য গত নয় মাস প্রদর্শনী বন্ধ রয়েছে হল দুইটিতে।

হরিণাকন্ডু উপজেলার পার্বতীপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক রাইসুল ইসলাম বলেন, সারাদেশে ঝিনাইদহ জেলাটি সাংস্কৃতিক এলাকা হিসেবে সুপরিচিত। সপ্তাহের ছুটির দিনেও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিনেমা হলে যাবে তার কোনো সুযোগ নেই।

ঝিনাইদহ জেলার কয়েকটি সিনেমা হল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার সবচেয়ে পুরনো ছবিঘর সিনেমা হলটি ভেঙে সেখানে মার্কেট তৈরি করা হচ্ছে। চন্দন সিনেমা হলটি এখন রীতিমত একটি কমিউনিটি সেন্টার। আবার কোথাও গুদাম হিসেবে সিনেমা হলকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় ঝিনাইদহে সিনেমা হলের জমজমাট ব্যবসা ছিল। এজন্য জেলার বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সিনেমা হল গড়ে ওঠে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিনেমা হলের ব্যবসা ভালোই চলছিল। প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে বাংলা ও হিন্দি ছবির প্রদর্শন শুরু হলে দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। দর্শকের অভাবে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হতে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ভিসিআরে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের জন্য অবৈধ মিনি সিনেমা হল গড়ে ওঠে। এরপর সিডি, ডিভিডি আবিষ্কারের পর বাড়িতে বসেই টেলিভিশনে ছবি দেখা শুরু হয়। যাদের বাড়িতে টিভি নেই, তারা চায়ের দোকানে বসে সিনেমা দেখেন। ফলে হলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর এজন্যই সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়েছে বলে তারা জানান।

এ বিষয়ে জেলা তথ্য অফিসার আবু বকর সিদ্দকী জানান, উন্নত কারিগরি দক্ষতার অভাব, ডিসলাইন, ইউটিউব, টুইটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডাউনলোড দিয়ে মোবাইল ফোনে নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দেখা ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা এবং ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন ও পশ্চিমা সংস্কৃতির রঙ্গিন আলোর ঝলকানিতে সাধারণ দর্শক এখন আর অন্ধকার হলের বড় পর্দায় ছবি দেখতে আগ্রহী না। সিনেমা হল গুলো দর্শকের অভাবে এবং লোকসানের মুখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button