ঝিনাইদহ সদরটপ লিড

মুক্তিযুদ্ধে ৫ সদস্যের মৃত্যুর পরও ঝিনাইদহের পরিবারটির পাশে নেই কেউ

ঝিনাইদহের চোখ-
দেশ তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রাপ্তে, শত্ররা এলাকা ছাড়ছে। কোথাও কোথাও তখনও আক্রমন হচ্ছে, মারা যাচ্ছেন মুক্তিপাগল ছেলেরা। মোকছেদুর রহমান এর বাড়ির কাছেই ছিল মুক্তিবাহিনীর এক শক্ত ঘাটি। তাদের লুকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে খাবারের জোগান দিতেন বাড়ির মালিক মোকছেদুর নিজেই।

ঘটনার দিনও দুপুরের খাবার পৌছে দিয়ে নিজ ঘরের বারান্দায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসেছিলেন। ভাবছিলেন রাতের খাবার কি হবে। এমনই সময় হঠাৎ গিলাবাড়িয়া গ্রামের আকাশে শত্রæর বিমান। বিকট শব্দে পর পর বেশ কয়েকটি বোমা এসে পড়ে তার বাড়িতে। বোমায় মোকছেদুর রহমান তার স্ত্রী ছকিনা খুতনসহ তাদের তিন সন্তান মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বেঁচে যান ১০ বছরের এক ছেলে মিজানুর রহমান ও ৮ বছরের এক মেয়ে চায়না খাতুন।

পরিবারের বর্তমান সদস্যদের বক্তব্য, স্বাধীনতার পর স্বজন হারানো এতিম দুই শিশু অনেক কষ্ট করেই বড় হয়েছেন। বড় করে তুলেছেন তাদের সন্তানদের। পড়ালেখাও করিয়েছেন, কিন্তু স্বাধীন দেশে তাদের কর্মসংস্থান হয়নি। পায়নি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি। আর এই স্বীকৃতির জন্য তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতে রিট দাখিল করেছেন, যা শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।

মোকছেদুর রহমান ছিলেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গিলাবাড়িয়া গ্রামের ভয়মান জোয়ার্দ্দারের পুত্র। তিনি পেশায় ছিলেন আইনজীবী সহকারী। তার স্ত্রী ও ৫ সন্তান ছিল। যার মধ্যে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর শত্রæর বোমা হামলায় মোকছেদুর রহমান তার স্ত্রী ছকিনা খাতুন সহ ৫ জন মারা যান। মারা যাওয়া অন্যরা হলেন তার তিন সন্তান তোতা মিয়া, পাতা মিয়া ও এক মেয়ে রানু খাতুন। বেঁচে যান বড় ছেলে মিজানুর রহমান (১০) ও ছকিনা খাতুন (৮)।

মোকছেদুর রহমানের ভাতিজা শামছুর রহমান (৭০) সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে জানান, পাকিস্থানি বিমান বাহিনীর বিমান তাদের গ্রামের উপর ঘুরতে থাকে। তারা সবাই ছোটাছুটি শুরু করেন। চাচা মোকছেদুর রহমান ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। হঠাৎ শত্রæ সেনারা তাদের বাড়িঘরের উপর বোমা ছুড়তে শুরু করে। ঘটনাস্থলেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মারা যান মোকছেদুর রহমান। মারা যান তার স্ত্রী ছকিনা খাতুন, মেয়ে রানু খাতুন, ২ ছেলে তোতা মিয়া ও পাতা মিয়া। আহত হয় ছোট মেয়ে চায়না খাতুন। বাড়ির বাইরে থাকায় বেঁচে যান বড় ছেলে মিজানুর রহমান। বেঁচে যাওয়া মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এখনও চায়না খাতুন মুখে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন।

মিজানুর রহমান জানান, ছোট বেলায় বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। তাদের এক চাচী জয়গুন নেছা রান্না করে দিতেন, তাই খেয়ে বেঁচে ছিলেন। রাত হলেই ভয় নিয়ে ঘুমাতে হতো। অনেক দিন ঘরের মধ্যে দুই ভাই-বোন কান্নাকাটিও করেছেন। তিনি আরো বলেন, একটি সময় বাঁচার জন্য তিনি দর্জির কাজ শুরু করেন। এই দর্জির কাজ করেই জীবন চালিয়েছেন। এখন তার চার ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটি বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে শাহীনুর আলম একটি ফার্মেসীতে কাজ করেন। মেঝো ছেলে তুহিনুর আলম সিএ শেষ করে এখন বেকার। সেজো ছেলে তুষানুর আলম জগনাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমএ করে বেকার। ছোট ছেলে জুলফিকার আলী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিবিএ করে এখন বেকার। মিজানুর রহমানের দাবি তদ্বির করার কেউ না থাকায় ছেলেদের চাকুরী হচ্ছে না।

বড় ছেলে শাহীনুর আলম জানান, তাদের পরিবারটি যুদ্ধের সময় শেষ হয়ে গেছে। বেচেঁ যাওয়া একমাত্র ছেলে তাদের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় তিনি পড়ালেখা বেশি করতে পারেননি। তবে ছোট ভাইদের পড়ালেখার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু চাকুরী হচ্ছে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের জন্য ২ হাজার করে টাকা অনুদান দেন। এই তাদের শেষ প্রাপ্তি। কিন্তু তারা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি চান। এ জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ছুটেছেন। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়ায় উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। যা বর্তমানে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। রিটকারীর পক্ষের আইনজীবি মোঃ মনিরুজ্জামান লিংকন জানান, তারা পরিবারটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আদালতে চেয়ে আবেদন করেছেন। আশা করছেন শুনানী শেষে রায় তাদের পক্ষেই আসবে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার সিদ্দিক আহমেদ বলেন, স্বাধীনতায় পরিবারটির অবদান ছিল। স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। সরকারের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন আশা করেন।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ বদরুদ্দোজা শুভ জানান, নতুন ভাবে তালিকাভুক্ত করার কোন চিঠিপত্র আসেনি। এ ধরনের কিছু আসলে অবশ্যই যথাযত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে, যা যাচাই বাচাই সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button