ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঝিনাইদহ হরিনাকুন্ড ‘দিগনগর’ পুরাকীর্তি
ঝিনাইদহের চোখ-
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সীমাহীন উদাসীনতা ও অবহেলায় প্রায় হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন হরিনাকুন্ডুর ‘ দিগনগর ঢিবি’ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে। ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য নিদর্শনগুলো।
১২ অক্টোবর ১৯৭৮ সালে একটি গেজেটের মাধ্যমে স্হানটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ‘সংরক্ষিত ঘোষিত পুরাকীর্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্হানটিকে কেবল পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেই দায়মুক্ত হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। ঘোষণার পর অতিবাহিত হয়েছে দীর্ঘ ৪২ বছর। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এই স্হানটিতে অদ্যবধি চালানো হয়নি কোন খননকাজ। স্থানটিকে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণর জন্য নেওয়া হয়নি নুন্যতম কোন পদক্ষেপ।
স্থানটির সংরক্ষণ ও খনন নিয়ে প্রায় চার যুগ ধরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক ধরনের রহস্যময় নীরাবতা ও অবহেলার কারণে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাটি হারিয়ে যেতে বসেছে কালের গর্ভে।
হরিনাকুন্ডু উপজেলার দিগনগরে অবস্হিত প্রাচীন একটি পুকুরের পাশে একটি মাটির ঢিবির ভেতরে প্রচুর প্রাচীন ইটের নমুনা ও মৃৎপাত্রের নিদর্শন পাওয়া যায়। স্থানীয় প্রবাদ মতে, ঢিবিসহ পার্শ্ববর্তী জমির মাটির নিচে বিশাল জায়গা জুড়ে একটি ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। ধ্বংসাবশেষটি শালিবাহন রাজার রাজবাড়ি বলে চিহ্নিত করা হয়। ঢিবি ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পর্যালোচনা করে ধ্বংসাবশেষটি হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের অর্থাৎ নূন্যতম হাজার বছরের পুরাতন একটি নিদর্শন হতে পারে বলে ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় স্হানটিতে পুরাকীর্তির দৃশ্যমান কোন নমুনা নেই। স্হানীয় গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢিবিতে ও জমিতে কাজের সময়ে নানা মৃৎপাত্রের নিদর্শন পেয়েছেন তারা। একটি লাশ দাফনের জন্য ঢিবি সংলগ্ন জমিতে কবর খুড়তে গিয়ে মাটির নিচে থাকা ছাদের অস্তিত্ব আবিস্কার করেন এলাকাবাসী।
কয়েকজন গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৮ সালে স্হানটিতে অধিদপ্তর থেকে লোকজন এসে জমি মাপ-জোক করে সাইনবোর্ড টানিয়ে জমি খনন করার কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আর কোনদিন তারা কেও আসেননি।
দিগনগরের পুরাকীর্তির বর্তমান বাস্তবতা হলো-মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে রাজবাড়ি, আর তার ঠিক উপরের মাটিতে করা হয়েছে পানের বরজ, বরজের চারপাশ জুড়ে করা হচ্ছে ধান চাষ। পানের বরজ আর ফসলী জমির মাটির নিচে অনাদরে অবহেলায় বিস্মৃত হতে বসেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঘোষিত ‘দিগনগর পুরাকীর্তি’। লোকমুখে প্রচলিত ‘জমিদারবাড়ির গুপ্তধনে’র খোজে স্হানীয়রা বেশ কিছু জায়গায় খনন করে পুরাকীর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই স্হানটিকে সংরক্ষণের কোন তাগিদ নেই দায়িত্বশীল মহলের।
জনশ্রুতি আছে- শালিবাহন রাজা তার এই রাজবাড়ি থেকে যশোর পর্যন্ত কড়ি দিয়ে এক রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। রাজপথটি স্হানীয়দের কাছে কড়ির জাংগাল নামে পরিচিত। কয়েক বছর পূর্বেও এলাকায় সেই জাংগালের উল্লেখযোগ্য কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান ছিলো। জাংগালটি ফসলি জমির ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্হানীয় কৃষকগন নিজেদের জমি সংলগ্ন জাংগালের মাটি কেটে মাঠের সমতল করে ফসল চাষ করছেন। হারিয়ে গিয়েছে শালিবাহন রাজার কড়ির রাজপথ। দিগনগর ঢিবির নিকটবর্তী অতি প্রাচীন যে দীঘি ছিলো সেটারও অনেক অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এভাবেই একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে হরিনাকুন্ডুর দিকনগরে অবস্হিত বাংলার হিন্দু-বৌদ্ধযুগের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো।
স্হানীয় বাসিন্দা শিলু মন্ডল বলেন, স্হানটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ যাতে গ্রহণ করা হয় সেজন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, দীর্ঘদিন ধরেও এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরাকীর্তি অবহেলায় পড়ে থাকা দুঃখজনক। পুরাকীর্তিটি হরিনাকুন্ডুবাসীর জন্য গর্বের। যদি স্হানটিতে সংরক্ষণপূর্বক খননকার্য চালানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হতে পারে।
হরিনাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা নাফিসা সুলতানা বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের সাক্ষী এই স্হানটি সংরক্ষণ হওয়া জরুরি। খনন ও সংরক্ষণের জন্য যাতে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগ করা হবে।