দেখা-অদেখা

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি

ঝিনাইদহের চোখঃ

বাড়ির খুব কাছেই থাকি অথচ কুঠিবাড়িটা কখনোই দুচোখ দিয়ে দর্শন করতে পারিনি, এ আফসোস আমার দীর্ঘদিনের। স্বয়ং বিশ্বকবির যেখানে তিন দশকেরও অধিককাল পদধূলি পড়েছে সে স্থানটা দর্শন না করাটা আমার মতো নিবিড় সাহিত্যপ্রেমীর জন্য চরম দুর্ভাগ্যেরই ছিল বৈকি। কেন রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে … একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু! আমার অবস্থাও ছিল তেমনটাই। বহু জায়গায় পা পড়েছে, কেবলই যাওয়া হয়নি রবীন্দ্রভবনে। সে আফসোসের অবশ্য পরিসমাপ্তি ঘটল এবার।

ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়ার দূরত্ব পঞ্চাশ কিলোমিটার। আর কুষ্টিয়া থেকে কুঠিবাড়ি পর্যন্ত মোটামুটি বারো কিলোমিটার হবে। বহুদিনের জমানো সঞ্চিত উৎসাহ ব্যয় করে সত্যি সত্যিই এবার সার্থক হয়েছে সাহিত্য প্রেম-রবীন্দ্র মুগ্ধতা। বাংলার মাটি, বাংলার জল যে বিশ্বকবির কতটা প্রিয় ছিল সেটাও যথাযথ উপলব্ধি হল কুঠিবাড়ির একটি বিকেলে। দুই ভ্রমণপিপাসু বন্ধুবর ফখরুল আযম রাসেল ও হাসান হাফিজুর রহমান ডলারের সাহচর্যে রওনা দিলাম কুঠিবাড়ির উদ্দেশ্যে। কুষ্টিয়ায় পৌঁছতেই অন্তরে শিলাইদহের টান। সেই টানই টেনে নিয়ে গেল নিঃসীম সবুজের ফাঁক গলে বয়ে চলা আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে কুঠিবাড়িতে। কুষ্টিয়া চৌড়হাস থেকে মূল রাস্তার শেষ হয় আলাউদ্দিন নগর পর্যন্ত। তারপর থেকে সরু পাকা রাস্তা ধরে আলাউদ্দিন নগরের মাঝ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা পিচঢালা রাস্তা দিয়ে কবিগুরুর বাড়িতে যাত্রা।

যে মুগ্ধতা আহরণ এই যাত্রার উদ্দেশ্য সেই মুগ্ধতা আরও বৃদ্ধি পেয়ে গেল যাত্রাপথের চারদিকে কেবলই সবুজ ধানক্ষেত, গাছগাছালি আর মানুষের সংসার সাজানোর ব্যস্ততা চোখে পড়ায়। সত্যিই তো, গন্তব্যের পূর্ব পর্যন্ত যাত্রা পথটাও যদি সুখকর ও নয়নাভিরাম না হয় তাহলে মূল দর্শনীয় স্থানের প্রতি টানটা একটু মলিনই হয় বৈকি! গন্তব্য পথের সুশোভিত দৃশ্যে টানটা আমার আরও বৃদ্ধি পেয়ে গেল। প্রতিজন দশটাকা ভাড়ায় ভ্যানে চড়ে কুঠিবাড়ির পৌঁছলাম। বাড়িটার উচ্চতা আড়াইতলা।

বাড়িটাই হল স্থানটার মূল আকর্ষণ। অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে তৈরি বাড়িটার প্রকৃত সৌন্দর্য বলতে হলে বোধহয় বিশ্বকবির মতো কবিতার ভাষায় কবিতা লিখেই বলতে হবে। কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মিসরের পিরামিড নিয়েই তো অসাধারণ একটি উক্তি করেছিলেন, এখানে পাথরের ভাষা মানুষের ভাষাকে অতিক্রম করিয়াছে…। আমার মনে হয় স্বয়ং কবিগুরুর এই অসাধারণ উক্তিটি তার কুঠিবাড়ি সর্ম্পকেও অবলীলায় চালিয়ে দেয়া যায়। তবে পিরামিডের পাথরের স্থলে এখানে বসাতে হবে ইটের কথা।

বাড়িটার চারপাশ দর্শন করেও অসীম মুগ্ধতা অর্জন করা গেল। বারবার শিহরিত হয়েছি এই ভেবে, এই কি সেই বাড়ি! যে বাড়ির এই উš§ুক্ত প্রান্তর দিয়ে আমরা হাঁটছি ঠিক এইখান দিয়েই শতবর্ষ আগে হেঁটে বেড়াতেন বিশ্বকবি? হাতে থাকতো কাগজ আর কালির দোয়াত, কলম। পেছনে সগৌরবে-সোল্লাসে বয়ে চলা পদ্মা নদীর সঙ্গে কথা কইতেন আর গীতি-কাব্য লিখে লিখে বাংলার আকাশ-বাতাস পুলকিত করতেন। কল্পনায় যেন রবিঠাকুরকে বেশ কয়েকবার চাক্ষুস করারও সৌভাগ্য হল। হওয়াটাই স্বাভাবিক, বাড়িটার অক্ষত জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে খোলা জানালা দিয়ে কবিগুরুর বাংলার প্রকৃতি দর্শনে পুলক দৃষ্টি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।

কবিগুরু সম্ভবত গাছগাছালি খুবই ভালবাসতেন। আর ভালবাসবেনইবা না কেন? প্রকৃতির মতো মনটাও যে সবুজ না হলে তো বিশ্বকবি হওয়া যায় না। সে কারণেই বাড়িটার চারধারে পশ্চিম-পূব-উত্তর কোণে রবীন্দ্রবয়সী কিছু গাছের ছায়া মিলল। বাড়িটার পেছন দিকটায় যে সুবৃহৎ বয়স্ক কাঁঠাল গাছ এখনও বর্তমান সেগুলোর অনেক ডালপালা রবীন্দ নাথের এ বাড়িটিতে চলা-ফেরার সাক্ষি। মনুষ্য স্বরধ্বনি পেলে হয়তো সত্যি সত্যিই তাদের কাছ থেকে কবিগুরু সর্ম্পকে অজানা অনেক কিছুই জানা যেত। পুব দিকে একসারে দাঁড়ানো চারটা তালগাছ। তিনটা একত্রিত, একটু দূরে একটি তালগাছ একদম একা। প্রিয় ছড়াটি বোধহয় কবি ঠাকুর তার সময়ই এই গাছগুলোর কোনও একটি দেখেই লিখেছিলেন এটা মনে মনে কল্পনা করে আবৃত্তি করতে থাকলাম, তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে…।

ঠাকুর পরিবার ৩০ বিঘা জমির ওপর এ কুঠিবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করে। তিনতলা এ কুঠিবাড়ির স্থাপত্যশৈলী অনেকটা প্যাগোডার মতো। দুই বিঘা জমির ওপর চোখ জুড়ানো ও মনকাড়া অপরূপ দক্ষিণমুখী এ বাড়ির চারপাশে রয়েছে পদ্মার ঢেউ খেলানো বাউন্ডারি প্রাচীর। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী জেলার পতিসর ও পাবনার শাহজাদপুর নামক স্থানের জমিদারির মালিকপ্রাপ্ত হন। এসব জমিদারির কেন্দ্রস্থল ছিল শিলাইদহ।

জমিদারি কাজ তদারকি করার উদ্দেশ্যেই কবির ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথসহ অন্যরা কুষ্টিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর রূপ দর্শনে আগমন করেছেন শিলাইদহে। কবিগুরু শিলাইদহে প্রথম এসেছিলেন ১৮৭৬ সালে, পরবর্তী সময়ে ১৮৯২ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে। শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু শিলাইদহের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবির কাছে এতই ভালো লেগেছিল যে, কবি মুগ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। পদ্মা নদীর প্রতি কবির দুর্বার আকর্ষণ ছিল। এ শিলাইদহে ঠাকুর বংশের প্রায় সবই পল্লী ভবনে বাস করে পদ্মা, গড়াই বিধৌত পল্লী প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। ১৮৯২ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের ব্যবস্থাপনায় শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িটি গৌরবময় স্মৃতিরূপে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুঠিবাড়ির গুরুত্ব অনুধাবন করে কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজিতে ভরপুর এ রবীন্দ্র লীলানিকেতন। চিলাকোঠা স্থাপত্যে মূল ভবন ২ বিঘা জমির ওপর পদ্মার ঢেউ সাদৃশ্য বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত কুঠির ছাদের কার্নিশেও সেই একই ছাপ। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ৮টি করে ১৬টি এবং তিন তলায় ২টি, মোট ১৮টি কক্ষ রয়েছে। তিন তলায় ছিল কবির লেখার ঘর। এ ঘরে বসে কবি লিখেছেন অনেক কবিতা ও গল্প। উত্তরে পদ্মা, দক্ষিণে গড়াইয়ের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিপ্রতিভার যে দৃষ্টি দায়িনী ছিল তা এখান থেকে বোঝা যায়। দেশী-বিদেশী ফুলের সাদৃশ্য বাগান কবিভবনটি আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পুরো ভবনটি এখন জাদুঘর হিসেবে দর্শকদের জন্য উš§ুক্ত। জাদুঘরের নিচ ও দ্বিতীয় তলায় ১৬টি কক্ষেই কবি রবীন্দ্রনাথ, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কৃষক বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অর্থাৎ নানা বয়সের বিচিত্র ভঙ্গির রবীন্দ্রনাথের ছবি। বাল্যকাল থেকে মৃত্যুশয্যার ছবি পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে শিল্পকর্ম এবং তার ব্যবহার্য আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটিভাবে সাজানো। তিন তলায় রয়েছে কবির ব্যবহƒত আসবাবপত্র। এছাড়াও রয়েছে কবির নিজ হাতে লেখা কবিতা, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর প্রকাশিত কবির ছবি ও সনদপত্র। কবিভবনে ব্যবহার্য জিনিসগুলোর মধ্যে আরও আছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট, পল্টুন, ৮ বেহারা ও ১৬ বেহারা পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, সোফা সেট, আরাম চেয়ার, হাত পালকি, গদি চেয়ার, পালংক, চীনা মাটির তৈরি ওয়াটার ফিল্টারসহ অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস। এছাড়াও রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও বিভিন্ন মনীষীর গ্রপ ছবি এবং কবির আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম।

রক্ষক কাম গাইড শাজাহান আলী অনেক সাহায্য করেছিলেন কবি ও কবিবাড়ি সর্ম্পকিত তথ্য দিয়ে। কেবল আমাদেরই নয়, কুঠিবাড়িতে প্রতিদিন সকাল বিকালে আগত অজস্র দর্শনার্থীকে কুঠিবাড়ির ভেতরকার রবিঠাকুরের ব্যবহত বিভিন্ন আসবাবপত্র, কবির কর্মকাণ্ড, শিলাইদহে অবস্থান করে কবির সৃষ্টি সর্ম্পকিত ইত্যাকার বিষয়ে বরাবর তিনিই সবাইকে তথ্য দিয়ে থাকেন। শুনে গৌরবান্বিত হয়েছিলাম যে ১৯১২ সালের দিকে রবিঠাকুর এই বাড়িতে অবস্থান করেই নাকি গীতাঞ্জলি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। যে সাহিত্য কর্ম কেবল তাকেই নয়, বাঙালিকেও দিয়েছিল বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি ও গৌরব!

সন্ধ্যের আকাশের সূর্যটা নিজেকে হারানোর তালে যেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, রবীন্দ পল্লীর মায়া ছেড়ে বাড়ির পথে প্রত্যাবর্তন করি তিনজন। ফেরার পথে মায়া শুরু হয়।

আবার কবে সাক্ষাৎ হবে কুঠিবাড়ির সঙ্গে? যে বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি এখনও রবীন্দ স্মৃতির ধারণ করে দর্শনার্থীকে জানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানে উঠে বসলাম। পেছনে নানাবিধ জিনিসপত্রের পসড়া সাজিয়ে বসা দোকান থেকে একতারার শব্দ ভেসে আসতে লাগল।

ওখানে একতারাও বিক্রি হয়! কুঠিবাড়ি যতই পেছনে সরতে লাগল ওবাড়ির কৃষ্ণচূড়া গাছটার ফুলগুলো যেন ততটাই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে আলোকিত করতে শুরু করল সন্ধ্যার অন্ধকার!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button