প্রাচীন ফুটবলের আদি নাম “টু-সু-ছু পা”..কিমারী..হারপাসটাম
#এলিস হক, ঝিনাইদহের চোখঃ
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে চীন দেশে আড়ম্বরপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে আকর্ষণীয় একটা ক্রীড়া উৎসব পালিত হতো। এই একটি মাত্র ক্রীড়া উৎসবকে ঘিরে চমৎকার বাহারী রকমের সাজানো-গোছানো এবং বর্ধন শোভিত-সবকিছু’র একটা উত্তেজনার উচ্ছ¡াস ভরে উঠা। একটি নির্বাচিত পরিবেশে বেশ খোলামেলা জায়গা। মাঠের চারদিকে অদ্ভূত ভাষায় লিখিত পত্রালি-ফেস্টুন। এর চেয়েও বড় কথা-এ ক্রীড়া উৎসবটি নিয়মিত আসর বসতো কী না তাও বিশদভাবে জানা যায় না।
বিভিন্ন ইতিহাস থেকে প্রচারিত খবরে প্রকাশ, ঐতিহাসিক চৈনিক সভ্যতা যুগে পুরোনো সামরিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ক্রীড়াটি আসলে ফুটবল খেলার নাম ছিল না। অন্তত এই খেলা’র নাম যেটাই হোক, নিঃসন্দেহে খেলাটি ছিল-আদিম যুগীয় আমলের মোটামুটি একটি ধারার প্রতিচ্ছবি।
চীনা ভাষায় খেলাটি’র নাম, টু-সু-ছু পা। ঐ ভাষায় টু-সু কথাটি’র অর্থ-পা দিয়ে লাথি মারা। ছু অর্থ ঃ চামড়া তৈরি বল। পুরো অর্থ বোঝায়-‘চামড়ায় তৈরি বলকে পা দিয়ে লাথি মারো’। দেখলেন তো-এই নামটি বেশ নাতিদীর্ঘ। সংক্ষেপে-‘পায়ে বল মারা’। সুতরাং ঐ খেলাটি যে আদৌতে ফুটবল ছিল না, তা স্বীকারোক্তি না করেই কোনো উপায় নেই।
বলা চলে, চীনারাই এই খেলার প্রথম সূতিকাগার। তবে এটা নিয়ে অনেক গবেষকদের মধ্যে প্রবল ওজর-আপত্তি। দ্বিধা দ্ব›েদ্ব’র মধ্যে আছেন কেউ কেউ। ঐ খেলার ইতিহাস স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনা দিতে না পারলেও অধিকাংশ দেশের ঐতিহ্য-কৃষ্টি’র পরিবেশে তা এই খেলার জন্ম।
‘গোল’ এখনকার মতো তখনও ছিল। গোল মানে-হারজিৎ নির্ধারিত খেলা। তবে তখনকার গোলের খেলা, একালের মতো নয়। গোল আর খেলোয়াড় সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি ছিল। একটি দল একক বা দু’জন খেলোয়াড় নিয়ে ফুটবল খেলা হয়। যেটা এখন যাকে বলে ‘গোল পোস্ট’।
নয়নে-স্বপ্নে তখন ঐ চেহারা সৌন্দর্য ছিল। ফিট তিরিশেক লম্বা একটি মাঠ। দু’টি পোল, এখনকার গোল পোস্টের চেয়ে ঢের উঁচু। গোল পোস্টের চিহ্নটি বেশ বড় সড়। মাত্র এক ফুট নির্দিষ্ট জায়গা। গোল করায় দারুণ জব্বর খেলা। তবে ঐ ফাঁক-ফোকরের মধ্যে বল গলিয়ে দেয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। পোলের কালোঘেঁষে বল বেরিয়ে গেলেও ঠিক বোঝা যেতো যে, ‘গোল হয়নি’। কারণ, দুই পোলের মাঝখানে তখনও একালের মতো জাল লাগানোর ব্যবস্থা ছিল। জাল অবশ্য সিল্কের। ফুটবলের আদি ইতিহাসের এই হচ্ছে একটি কিস্সা।
চীনা সংস্কৃতি’র অনেক কিছু জাপানীরা তৈরি করেছিল। সেই জাপানের একটি খেলার নাম-‘কিমারী’। অনেকটা ফুটবলের কিছুটা সাদৃশ্য। কিমারী বুঝি, টু-সু-ছু’র চেয়ে ফুটবলের খুব কাছাকাছি। প্রায় ১৪ স্কোয়ার মিটার পরিমাণ মতো জমি। মাঠের নানা কোণে ভিন্ন ভিন্ন গাছ থাকতো। খেলোয়াড় সংখ্যা ৮ জন। এই বলটি নিয়ে ৮জন কিক করে। একে অন্যকে বলে পাস দেয়।
জানা যায়, পূর্ব দেশের এই খেলা নাকি আলেকজান্ডারের যুগে তাদের সৈন্যরাও খেলতো। এক ধরণের বল খেলা ম্যাসিডোনিয়ায় নিয়ে যায়। গ্রীক নাট্যকার এ্যান্টি ফেইন্সের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, ‘বল ধরে আনন্দের সঙ্গে একজন খেলোয়াড় নিজ দলের আরেকজনের কাছে পাস দিয়ে দিতো। সেও একজনকে কাটিয়ে, একজনকে এড়িয়ে তৃতীয় জনের কাছে বল ঠেলে দিয়ে দর্শকসহ সকল খেলোয়াড়রা চিৎকার করে বলতো-পাস দাও, লম্বা করে মারো, ওকে কাটাও, নিচে নামো, উপরে যাও, ছোট্ট করে পাস দাও ইত্যাদি।’
আরো জানা যায়, রোমান যোদ্ধারাও নিজেদের মধ্যে এরকম এক খেলাকে বেশ জনপ্রিয় গড়ে তোলে। এই খেলাটিও কিন্তু ফুটবলের মতোই ছিল। এরা এর নাম দেয়-‘হারপাস্টাম’। রোমানরা হারপাস্টাম খেলা ইউরোপে নিয়ে যায়। এ খেলা ইউরোপের প্রতিটি দেশে দেশে রবিবারের খেলা দিয়ে কিছুদিন চালু রেখেছিল।
ফুটবলের ইতিহাস লিখতে গিয়ে অনেক ইতিহাসবিদেরা ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘অজানা এই একটি খেলা ইংল্যান্ডে যখন আসে। তখনকার তাদের রাজ্যে চরম দুর্দিন অবস্থা। সেই সময়ে এই খেলা ফুটবল না বলাই সঙ্গত হবে।
সেই বর্ণনার বর্ষকাল ১০৬৬ সাল। মোটামুটি দু’টি গ্রামের মধ্যে খেলা। রীতিমতো যুদ্ধ। লম্বা মাঠ, আধা মাইলের মতো হবে হয়তো। খেলোয়াড়রা বেশুমার। সেই খেলায় কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই ছিল না। রুক্ষতা, রুঢ়তা ও উন্মুত্ততায় ভরা। এমন যুদ্ধে অবলীলায় অনেক খেলোয়াড়-যোদ্ধাদের প্রাণ যাচ্ছে। হাড়-গোড় শুদ্ধ আলাদা হচ্ছে। তবুও কুচ পরোয়া নেহি। ওদেশের সমর্থকের মধ্যে এই ইংল্যান্ডে এখনও সেই গ্রাম্য বিভৎস্যতা একালেও আবার কিছুটা ফিরে আসে।
একালের ইংল্যান্ডের ফুটবল সমর্থকরা দাঙ্গাবাজ হিসেবে সত্যিই ভয়াবহ। সাংঘাতিক! বিপদজনক গণখেলায় জীবননাশের পরিমাণ বাড়ছে। তবুও খেলা থামেনি। নিরন্তর চলছে। রাজপ্রাসাদ থেকে বার বার ফরমান জারী করছে। ‘বন্ধ করো, এই গণখেলা’।
এ এমন মাদকতার নেশা যে ফরমান-টরমানকে কেউ তোয়াক্কাই করলো না। তারা ক্রমেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠলো। ছাগল যেমন চোখ বন্ধ করে ঘাস চিবিয়ে খায়। ঠিক তেমনি এদের অবস্থাও তদ্রæপ। ইংরেজ সাহিত্যিক সেক্শপিয়ার নিজেও এক পত্রে লিখতে বাধ্য হলেন-‘কমেডি অব ইরোর্স।’ দ্বিতীয় এ্যাডওয়ার্ড ফুটবল নিয়ে এই উন্মাত্ততার বিপক্ষে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার আহŸান করেছিলেন। কিন্তু শোনে কার কথা?
১০৬৬ খৃস্টাব্দ গড়িয়ে ১৪০০-১৬০০ শতকে পৌঁছালো। এই দুই শতকে ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। রাজ্যের চারদিকে বিস্তর সমালোচনা, নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সবকিছু’র নিষিদ্ধ জারীর পরেও ঐ গণখেলার রেশ এতোটুকুও ¤øান যায়নি।
এই সময়ে ইতালীতে দেখা গেল-নতুন এক খেলার সুষমা। নতুন শিল্প খেলার পুরিপূর্ণরূপ ধেয়ে আসতে থাকে। কারুকার্য তখনও বিদ্যমান। রীতিমতো আকর্ষণীয় কৌশলময় খেলা। সেদেশের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হয়ে উঠলো-‘ক্যালচিও’। ক্যালচিও’র খুব কাছাকাছি একটি শব্দের উৎপত্তির উৎস। ক্যালচিয়ার মানে হলো-কিক। ক্যালচিয়ার থেকে ক্যালচিও অর্থাৎ ফুটবল।
শুধু ফুটবল নয়। ইতালীর ভাষায় রচিত ক্যালচিও মানে ‘খেলার রাজা’। এ খেলায় তেমন রাফনেস-ভায়োলেন্স নেই। একজন শিক্ষক খেলা পরিচালনা করতেন এবং প্রশিক্ষণও দিতেন। শিক্ষকরাও আবার কোচ ও কর্মকর্তা হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেকালের ফুটবল বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল বিশাল মানের। এই ধরণের নিয়মকানুন তারও ৩০০ বছর পরে আবার চালু হলো।
ঊনিশ শতকে ইংল্যান্ডে একজন স্কুল শিক্ষক ইতালীতে ফুটবলের এই শান্ত চেহারায় কিছু খেলা দেখেছিলেন। নাম রিচার্ড মুলকাস্টার। তিনি ইংল্যান্ডের অন্যান্য স্কুলেও ফুটবলকে নতুন পদ্ধতিতে ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করেন। সেদেশের মাঠ-টাঠ সব স্কুলে ছিল না। তবুও তারা পিছিয়ে যায়নি।
নতুন উদ্যোম নিয়ে তারা তাদের আর্থসামাজিক পরিবর্তনে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। বলা চলে-সেদেশের নতুন ফুটবল যুগে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। এই টু-সু-ছু থেকে কিমারী, সেখান থেকে হারপাস্টাম। হারপাস্টাম থেকে ক্যালচিও এবং সবশেষে এই সেই চিরচেনা ফুটবল। তাহলে?
এলিস হক
ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার
বিপিএড (প্রথম শ্রেণী), ফুটবল-রাগবি-হ্যান্ডবল রেফারি