জানা-অজানা

কাঙাল হরিনাথ বাউল গান ও সাংবাদিকতার নির্ভীক পথিকৃৎ

#ঝিনাইদহের চোখঃ

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গ্রামীণ সাংবাদিকতার অনন্য পথিকৃৎ। ছিলেন একাধারে ছিলেন একধারে সাহিত্যশিল্পী, সংবাদ-সাময়িকপত্র পরিচালক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক, সাধক ও ধর্মবেত্তা। বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস লিখতে গেলে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম সবার আগে চলে আসে।

শ্রী হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ ১৮৩৩ সালের ২০ জুলাই (১২৪০ বঙ্গাব্দ) তৎকালীন নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার গড়াই তীরবর্তী কুমারখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ১৮৬তম জন্মবার্ষিকী। তার ছদ্মনাম হচ্ছে ফিকির চাঁদ। তবে কাঙাল হরিনাথ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সমাজ বিনির্মাণ ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল।

শৈশবেই পিতা-মাতাকে হারান হরিনাথ মজুমদার। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং তাদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে হরিনাথ সারাজীবন আন্দোলন করেছেন। অত্যাচারিত এবং অসহায় কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করেন।

১৮৫৫ সালে বন্ধুদের সহায়তায় তিনি নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং গ্রামের সাধারণ লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে সেখানে অবৈতনিক শিক্ষকরূপে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরের বছর তাঁরই সাহায্যে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অল্পশিক্ষা নিয়েই তিনি শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। একইভাবে দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ে তার ক্ষুরধার লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন।

বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস লিখতে গেলে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম সবার আগে চলে আসে। বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক ও গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথের সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা’ বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। চলমান সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় তার আদর্শ যেন আজ রূপকথার কাহিনির মতো। তার মত সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠাবানই একজন প্রকৃত নির্ভীক সাংবাদিকের আদর্শ হওয়া উচিত।

তৎকালীন সময়ে তিনি ইংরেজ নীলকর, জমিদার, পুলিশ ও শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে হাতে লেখা পত্রিকা ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশিকা’র মাধ্যমে লড়াই করেছেন। অত্যাচার ও জলুমের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন কলমযোদ্ধা। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লিখে নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে ১৮৫৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর প্রাচীন জনপদের নিভৃত গ্রাম থেকে তিনি হাতে লিখে প্রথম প্রকাশ করেন মাসিক ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশিকা। হাজারো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি এ পত্রিকাটি প্রায় এক যুগ প্রকাশ করেছিলেন।

১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি এলাকা থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। নিজগ্রামের লোকের উপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষ্যে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ইশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ। কবির উপদেশে তার (কাঙাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো।

তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা।’ শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও, কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কেচ্ছা-কাহিনীও প্রকাশিত হতো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশী জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও ১৮৭৩ সালে কুমারখালির নিজ গ্রামেই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী’র অর্থ আনুকূল্যে কাগজ চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসনের ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়।

দীর্ঘ আঠারো বছর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগপূর্বক তিনি ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন। হরিনাথ মজুমদার আধ্যাত্মিক গুরু ও মহান সাধক ফকির লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। ধর্মভাব প্রচারের জন্য তিনি অধ্যাত্মবাদ প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে ‘কাঙাল ফিকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। হরিনাথের স্বরচিত গানগুলোও আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর ছিল।

বাউল গানের ক্ষেত্রে হরিনাথের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। লালন প্রভাবে কাঙাল হরিনাথ অসংখ্য বাউল গান রচনা করেছেন। অধিকাংশ গান খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি সহজ ভাষায় ও সহজ সুরে গভীর ভাবোদ্দীপক গান রচনা করতেন। গান রচনায় তিনি অসম্ভব পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। স্বলিখিত গানে কাঙ্গাল ভণিতার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ছিল। তাঁর রচিত বাউল সঙ্গীতগুলো ফকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম সাধনার অঙ্গরূপে তিনি বহু সহজ-সুরের গান রচনা করে সদলবলে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন।

বিশুদ্ধ-শিল্প প্রেরণার সাহিত্যচর্চায় ব্রত ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। একই সঙ্গে তিনি বেশ কিছু উত্তরসূরিও রেখে যেতে সক্ষম হন। তাদের রচনা এবং কাঙালের রচনা আজো বাংলা সাহিত্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়ে আছে। সংগ্রামে অবতীর্ণ এই সাধক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পার করেছেন কর্মমুখরতায়।

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার শুধু একজন সফল সাংবাদিকই ছিলেন না। তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তকও লিখেছেন। এ ছাড়া রচনা করেছেন নাট্যগ্রন্থ ও বিভিন্ন প্রবন্ধ গ্রন্থ। বিভিন্ন গবেষকদের লেখা থেকে জানা যায়, হরিনাথ মাজুমদার ৪০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিতই রয়েছে বেশিরভাগ।

কাঙাল হরিনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ ও সমকালিন। কিন্তু হরিনাথ মজুমদারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। কথিত আছে, সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয়েছিল যে কবিগুরু হরিনাথ মজুমদারকে তাঁর কুঠিবাড়িতে ধরে নেওয়ার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়েছিলেন।

সুফি বাউল লালন শাহ সে সময় লাঠিয়াল বাহিনী প্রতিহত করে শিষ্য হরিনাথ মজুমদারকে নিরাপদ করেছিলেন। শুধু একবার নিরাপদ করে শান্ত হননি। সাঁইজি দিনের পর দিন লোকজন নিয়ে পাহাড়া দিতেন হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি ও কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর বিখ্যাত সেই প্রেসটি। স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়ার নকশায় কুমারখালীতে হরিনাথ মজুমদারের বাড়ির পাশেই নির্মিত হয়েছে কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি কমপ্লেক্স।

তার স্মৃতিগুলো সরকারি উদ্যোগে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মিউজিয়াম, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরী নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র এম এন প্রেস-এর মডেল, কিছু যন্ত্রাংশ, বাংলা টাইপ অক্ষর, ছবি ও কিছু পাণ্ডুলিপিসহ বেশকিছু কালের সাক্ষী স্মৃতি জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। দেশে ও দেশের বাইরের বিশেষ করে কলকাতার অনেক পর্যটক দেখতে আসছেন এই জাদুঘর।

দর্শনীয় নির্মাণশৈলীর দুইতলা ভবনে কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের গ্যালারীতে ১৬৬টি নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে কিছু নিদর্শন ফ্রেমে আটকানো এখনো হয়নি। মনোরম নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যা প্রায় পাঁচ শত। রয়েছে একটি আধুনিক মিলনায়তন, যার আসনের সংখ্যা শতাধিক।

সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের দুইতলা দৃষ্টি নন্দন ভবনে ছোট বড় ১৫টি কক্ষ রয়েছে। সামনে রয়েছে সান বাঁধানো মুক্তমঞ্চ, সেখানে সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ভাস্কর্য শোভা বৃদ্ধি করেছে। সমগ্র জাদুঘরটি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করা হয়। তাছাড়া মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সাহায্যে সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুদদারকে নিয়ে ভিডিও প্রদর্শনেরও ব্যবস্থা রয়েছে।

১৮৯৬ সালের ১৬ই এপ্রিল ক্ষণজন্মা এই লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, ‘নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো’। তার মৃত্যু পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে হরিনাথ গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button