#ঝিনাইদহের চোখঃ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত বেতনা নদীটি অন্যতম একটি প্রাচীন নদী।
এ নদীটি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর, যশোর জেলার চৌগাছা, শার্শা ও ঝিকরগাছা উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার তালা, কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর এবং আশাশুনি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
১৫০ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে এ নদীটির নিষ্কাশন এলাকার আয়তন প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর এবং বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় ১০ লাখ অধিবাসী বসবাস করে। এ নদী জোয়ারে আগত পলি দ্বারা ভরাট হওয়ার দরুন বিগত দুই দশক ধরে প্রতি বর্ষা মৌসুমে এলাকায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে এই জনপদ প্লাবিত হয়ে এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে বাস্তুভিটা ত্যাগকারীর সংখ্যা।
মরে গেছে বেতনা নদী। দেড় শ’ কিলোমিটার নদীর অবশিষ্ট ২০ কিলোমিটার নদী এখন পলি ভরাটে ধুঁকছে। নামমাত্র জোয়ারের পানিতে নিচের অংশে এই বিশ কিলোমিটার নদীর অস্তিত্ব এখনও বেতনা নদীর অবস্থান জানান দিলেও বাকি ১শ’ ৩০ কিলোমিটার নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর এজন্য নদী পরিচিতির জন্য বিনেরপোতা ব্রিজের পাশেই টানানো হয়েছে বেতনা নদীর সাইনবোর্ড। বেশিরভাগ নদী ও তীর দখল হয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে নেয়া সাতক্ষীরা অঞ্চলের এই নদীর ৪৪ কিলোমিটার খননের জন্য প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার প্রকল্প প্ল্যানিং কমিশনে পড়ে আছে গত ২ বছর ধরে। এই ৪৪ কিলোমিটার খনন হলে উপকৃত হবে অববাহিকার ৫ লাখ মানুষ। ক্যাচমেন্ট এরিয়ার প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসর আবাদ নিশ্চিত হবে।
বেতনা নদীর উৎপত্তি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা সদরের ভৈরব নদ থেকে। প্রায় দেড় শ’ বছর পূর্বে বেতনা নদী ভৈরব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বেতনার উৎস মুখ মহেশপুর উপজেলা সদরে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। উৎপত্তি স্থল থেকে দক্ষিণে ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করে পুনরায় বেতনা শার্শা উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মহেশপুর উপজেলায় পলি ভরাটের কারণে বেতনা মরা গেছে। শার্শা উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের অবৈধ দখলের কারণে নিষ্কাশন পথ এখন বন্ধ। ফলে এই এলাকার জলাবদ্ধতা এখন প্রতিবছরের ঘটনা। অতিবৃষ্টি, এক নাগাড়ে কয়েকদিন বৃষ্টি বা ভারতীয় পানির অনুপ্রবেশ ঘটলে এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার উজানে শার্শা উপজেলার বিল এরিয়া থেকে মরে যাওয়া বেতনার সংযোগ রয়েছে আশাশুনি উপজেলার চাপড়া এলাকায় মরিচ্চাপ নদীর সঙ্গে। এখান থেকে বেতনার দৈর্ঘ্য ১০০ কি.মি.-এর অধিক। দু’পাশে ক্যাচমেন্ট এলাকার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর। বর্তমান বেতনার ভাটিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা তথা সদর উপজেলার শ্যাল্যে পর্যন্ত ভরা জোয়ার পানি ওঠে। শ্যাল্যে থেকে বিনেরপোতা ব্রিজ হয়ে ওপরে শার্শা পর্যন্ত বেতনা আর বেঁচে নেই।
এদিকে বিনেরপোতা থেকে খেশরা ইউনিয়নের শালিখা পর্যন্ত দীর্ঘ বেতনার অন্যতম শাখা নদী শালিখাকে পোল্ডার ব্যবস্থার আওতায় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া রয়েছে অপরিকল্পিত ঘের বেড়ির মাছের চাষাবাদ। এসবের ফলে নগরঘাটা, সরুলিয়া, মাগুরা, খেশরা, খলিশখালী, জালালপুর, ধূলিহর প্রভৃতি ইউনিয়নের পানি নিষ্কাশনে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকালে এলাকায় ফসল আবাদ করা যায় না।
পূর্বে মহেশপুর, চৌগাছা, শার্শা, ঝিকরগাছা-কলারোয়া প্রভৃতি বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে বর্ষা মৌসুমে যে পানি আসত তার অধিকাংশ পানিই বেতনা তার শাখা নদী, নৌখাল, প্রাণসায়ের, ব্যাংদহ, শালিখা, পাকুড়িয়া প্রভৃতি নদীর মাধ্যমে মরিচ্চাপ, লাবণ্যবতী এবং কপোতাক্ষ নদীতে নিষ্কাশিত হতো। বর্তমানে পোল্ডার ব্যবস্থার কারণে এই ব্যবস্থা মরে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে যতটা সম্ভব পূর্বের নদী ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া এবং পূর্বের নদীগুলো খনন করে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ প্রদান করার দাবি উঠেছে। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য শালিখা ও পাকুড়িয়া নদীর মাধ্যমে কপোতাক্ষের সঙ্গে সংযোগ, ব্যাংদহ, প্রাণসায়ের এবং নৌখালের মাধ্যমে লাবণ্যবতী ও মরিচ্চাপ নদীর সঙ্গে সংযোগ প্রদান করার দাবি উঠেছে। ইতোমধ্যে এ নদীটি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন ২ থেকে ১, ২ ও ৬-৮ পোল্ডারকে একসঙ্গে যুক্ত করে দুই বছর আগে আইডব্লিউএম-এর সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। এর আলোকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে একটেশন নিষ্কাশন প্রকল্প নামে এটি প্রকল্প প্ল্যানিং কমিশনে পাঠানো হয়। কিন্তু এটি অনুমোদন না হওয়ায় চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে একটি রিভাইজড প্রকল্প প্ল্যানিং কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এর প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৪শ’ ৯৭ কোটি টাকা।
প্রায় দেড় শ’ বছর পূর্বে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরে ভৈরব থেকে বেতনা নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, এখন আর পদ্মা প্রবাহের সঙ্গে বেতনা নদীর কোন সংযোগ নাই। পদ্মা প্রবাহের যত পানি মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হয় তার সব পানি এখন সীমান্তবর্তী নদী ইছামতি এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নদীতে চলে যাচ্ছে। ভৈরবের সঙ্গে মাথাভাঙ্গার সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে এবং বেতনার ওপরের অংশের নদী খনন পূর্বক ভৈরবের সঙ্গে পুনর্সংযোগ দিয়ে বেতনা নদীতে উজান প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারলেই পুনরায় বাঁচানো সম্ভব মরে যাওয়া বেতনা নদীকে এমনটি আশা করেন পরিবেশবিদ ও নদী সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এলাকার নদীগুলোর মধ্যে পরস্পরের সংযোগ এবং এর সঙ্গে উজান প্রবাহ যুক্ত হলে এলাকার সব নদীই তার পূর্বের প্রাণ প্রবাহ কিছুটা ফিরে পাবে এমনটি আশা পরিবেশবিদদের।