একটি জানাজার সাক্ষ্য
‘তাহরিকে তালেবানের’ মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান আমার বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া ঘোষণা করে। এরপর আমার গাড়ির নিচে বোমা রাখার দায়ও এহসান স্বীকার করে। ওই সময় মাওলানা সামিউল হক (রহ.) ইসলামাবাদে এসে আমাকে বলেন, বলÑ কার বিরুদ্ধে কী করতে হবে! আমি তোমার সঙ্গে আছি। করাচিতে আমার ওপর হামলা হলে তিনি আমার ও জিও টিভির পক্ষে ছিলেন
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেছিলেন, ‘আমাদের জানাজা আমাদের হক্কানিয়াত বা সত্যনিষ্ঠতার ফয়সালা করবে, সাক্ষ্য দেবে।’ ইমাম ইবনে হাম্বলের ইন্তেকালের পর তার জানাজায় তখনকার সময়ে বাগদাদে লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। তার জানাজার অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন হাজার হাজার অমুসলিম। ৩ নভেম্বর আকুড়াখটকে মাওলানা সামিউল হকের জানাজায় উপস্থিত কয়েকজন বিখ্যাত আলেম আমাকে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের ওই উক্তি স্মরণ করিয়ে বললেনÑ ‘এই জানাজা দেখুন আর মাওলানা সামিউল হক (রহ.) এর হক্কানিয়াত ও সঠিকতার ফয়সালা করুন। এত বিশাল জানাজায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষই মরহুমের রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। লোকজন একজন সাহসী ও সত্যপন্থি, দেশপ্রেমী ও বুজুুর্র্গ আলেমের দুনিয়াযাত্রার শেষে বিদায় অভিবাদন জানাতে এসেছিলেন, যাকে জুমার দিন আসরের সময় শহীদ করা হয়েছে। হত্যাকারীরা তাকে হত্যার জন্য এমন একটি সময়কে নির্বাচন করেছে, যখন সমগ্র দেশ নবী করিম (সা.) এর অবমাননার ইস্যুতে উত্তাল। স্বয়ং মাওলানা সামিউল হক (রহ.) কে শাহাদতের কিছুক্ষণ আগে জীবনের শেষ ভাষণে এ ব্যাপারে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার জানাজা ওই অস্থিরতা দীর্র্ঘায়িত করার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত করার মাধ্যম হয়েছে। মাওলানার শাহাদতের পর একশ্রেণির মর্যাদাহীন ও সমাজবিরোধী লোক বিভিন্ন মন্তব্য করেছে। একজন বলেছে, ‘ফাদার অব তালেবান’ দুনিয়া থেকে চলে গেছে। একজন বলেছে, তার মাদ্রাসা দারুল উলুম হক্কানিয়া আকুড়াখটকের ‘জিহাদের আঁতুড়ঘর’ ছিল। এমনকি কিছু মহিলা নেত্রী ও তাদের দোসর পুরুষ তো এ-ও বলেছে যে, মাওলানা সামিউল হক (রহ.) কে কেন শহীদ বলা হচ্ছে!
আমি যে মাওলানা সামিউল হক (রহ.) কে চিনি, তিনি সর্বদা মুচকি হেসে ভিন্নমতকে গ্রহণ করতেন। মাওলানার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় দৈনিক জঙ্গের সিনিয়র সহকর্মী মরহুম জাবেদ জামালের মাধ্যমে। ওই সময় মাওলানাকে জেনারেল জিয়াউল হকের সমর্থক ও সমচিন্তক ধারণা করা হতো। এদিকে আমি ছিলাম সামরিক শাসনের প্রবল বিরোধী। এসব সত্ত্বেও মাওলানার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গভীরতার সঙ্গেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বাকি ছিল। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এ সম্পর্ক চলমান রাখার ক্ষেত্রে তিনিই বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন। যে-কোনো সমস্যায় তিনি কোনো পত্র পাওয়া ব্যতীতই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং আমার অসামান্য সাহায্য করেও কখনও তা মুখে বলতেন না। কয়েক বছর আগে মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর হামলার পর প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দল ‘তাহরিকে তালেবান’ এর দায় স্বীকার করে। আমি ওই হামলার নিন্দা জানাই। ফলে ‘তাহরিকে তালেবানের’ মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান আমার বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া ঘোষণা করে। এরপর আমার গাড়ির নিচে বোমা রাখার দায়ও এহসান স্বীকার করে। ওই সময় মাওলানা সামিউল হক (রহ.) ইসলামাবাদে এসে আমাকে বলেন, বলÑ কার বিরুদ্ধে কী করতে হবে! আমি তোমার সঙ্গে আছি। করাচিতে আমার ওপর হামলা হলে তিনি আমার ও জিও টিভির পক্ষে ছিলেন। এটা ওই সময় ছিল, যখন কিছু ‘মুজাহিদে ইসলাম’ আমার বিরুদ্ধে গাদ্দারি ও কুফরির আদেশ জারি করে এবং অন্যদের কাছেও ফতোয়া কামনা করে। কিন্তু মাওলানা সামিউল হক (রহ.) কোনো ফরমায়েশি ফতোয়া দিতে পরিষ্কার অস্বীকার করেন। ২০১৬ সালে কিছু শক্তিশালী লোক ‘তাওহিনে রিসালাতের’ বিষয়টিকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল। একটি হত্যার বিপক্ষে আমি ‘গায়রত’ নামে কলাম লিখলে আমার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। এ সময়ও মাওলানা সামিউল হক (রহ.) আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং তার মাদ্রাসা দারুল উলুম হক্কানিয়া থেকে এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ফতোয়া প্রকাশ করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়Ñ শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কারও বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া বা হুকুম জারি করা বড় গোনাহ ও শরিয়তবিরোধী কাজ। জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর ও জামিয়া নাঈমিয়া লাহোর থেকেও ফতোয়া প্রকাশিত হয়; কিন্তু হক্কানিয়ার মুফতি মুখতারুল্লাহ হক্কানির ফতোয়া ছিল অত্যন্ত বিস্তারিত ও ব্যাখ্যাকৃত। কোনো কোনো বন্ধু যখন মাওলানা সামিউল হক (রহ.) কর্তৃক আমাকে সহযোগিতার ব্যাপারটিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তখন মাওলানা সামিউল হক (রহ.) তাদের ক্ষোভকে মুচকি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
নিজের জীবনেও মাওলানা সামিউল হক (রহ.) কে বেশ কয়েকবার মিথ্যা অপবাদের শিকার হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে এমন একটি অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। জনাব আতাউল্লাহ কাসেমীও নিজের কলামে সেটা উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য একজন দুশ্চরিত্রের মহিলাকে মাওলানার বিপক্ষে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই মহিলা কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। মাওলানা তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেও বড় বড় দল মাওলানার ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করেছিল। গেল কিছুদিন ধরে মাওলানা সামিউল হক (রহ.) লেখালেখি ও গবেষণার প্রতি বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন। ২০১৫ সালে দশ খ-ে ‘খুতুবাতে মাশাহির’ প্রকাশ করেন। দারুল উলুম হক্কানিয়ার গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের বয়ান ও মাসিক ‘আল হকে’ প্রকাশিত বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধগুলো ‘খুতুবাতে’ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। প্রথম খ-ে দারুল উলুম দেওবন্দের বিখ্যাত মুহতামিম মাওলানা কারি তৈয়ব সাহেবের লিখিত ধর্ম ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর সম্মান প্রদর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আলেমদের পরস্পর দোষারোপ করা উচিত নয়।
মাওলানা সামিউল হক (রহ.) ২০১৬ সালে নিজের ডায়েরি প্রকাশ করেন। যেসব লোক তাকে ‘ফাদার অব তালেবান’ বলে তাদের উচিত ডায়েরিটি পাঠ করা। মাওলানা সামিউল হক (রহ.) এর বাবা মাওলানা আবদুুল হক দরবেশ হাজী তারানগাজীর (রহ.) হাতে বায়াত ছিলেন। খান আবদুল গাফফারও তারানগাজীর অনুসরণ করতেন। মাওলানা সামিউল হক (রহ.) নিজের ডায়েরিতে আবদুল গাফফারের সঙ্গে হওয়া তার ওই কথোপকথন উল্লেখ করেছেন, যেটা ১৯৫৮ সালে হাজী তারানগাজীর ‘মুসলিহে তাহরিকের’ ব্যাপারে হয়েছিল। ওই তাহরিকের মূল উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ খেদানো। ডায়েরিতে কোথাও ওলি খানের হক্কানিয়া মাদ্রাসায় সাহায্যের কথা আছে। কোথাও আছে আজমল খটকের কথা। কোথাও মুফতি মাহমুদের সঙ্গে হরীপুর জেলে কাটান বন্দি জীবনের কথা আছে। কোথাও আছে লাহোরে দানাগঞ্জ বখশ (রহ.) এর মাজারে ফাতেহা পাঠ এবং বাহাউল হকের সঙ্গে সাক্ষাতের আলোচনা। আছে বাংলাদেশের মিরপুরে অবস্থিত শাহ আলীর মাজার জিয়ারতের কথাও।
মাওলানা সামিউল হক (রহ.) আফগানিস্তানের তালেবানের ব্যাপারে একটি ইংরেজি বইও প্রকাশ করেছেন। সেখানে উল্লেখ করেছেন আফগান তালেবানের অনেক মুজাহিদ তার মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন বটে; কিন্তু তিনি তার মাদ্রাসার কোনো পাকিস্তানি ছাত্রকে আফগানিস্তানে জিহাদের জন্য পাঠাননি। মাওলানা সামিউল হক (রহ.) এর জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি তিনি সর্বদা পাকিস্তানের আইনের ভেতর গণতন্ত্রের ব্যাপারে উৎসাহ ও সতর্ক করতেন, জোর দিতেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত ও বিশৃঙ্খলার শক্ত বিরোধী ছিলেন।
খায়বার প্রদেশে কিছু বিভ্রান্ত লোক পোলিও ওয়ার্কের ওপর হামলা করলে মাওলানা সামিউল হক ও মাওলানা ড. আলী শের আলী শাহ পোলিও ভ্যাকসিনের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন। নিজের শিষ্য মুহাম্মাদ ইসরার মাদানির মাধ্যমে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিকাহ একাডেমি জেদ্দা’ কর্তৃক প্রকাশিত কিতাবের উর্দু তরজমা ‘জাদিদ ফিকহি ফয়সালা’ নামে প্রকাশ করেছিলেন এবং ভূমিকায় সব দ্বীনি মাদ্রাসায় এ কিতাবকে সিলেবাসভুক্ত করার ওপর জোর তাগিদ দিয়েছিলেন। এ কিতাবে নিত্যনতুন গুরুত্বপূর্ণ মাসআলার সমাধান কোরআন ও হাদিসের আলোকে সহজভাবে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মাওলানার ইখলাস ও ইসলামের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কের কিছুটা চিত্র এ ভূমিকায় পাওয়া যায়। তার ইখলাসই আমাদের মতো গোনাহগার ও দুনিয়াদার বান্দাদের তার জানাজায় শরিক হতে বাধ্য করেছে। যে জানাজা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের বিখ্যাত উক্তিকে প্রমাণিত করেছে যে, আমাদের জানাজা আমাদের হক্কানিয়াতের ফয়সালা করবে।
পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও জিও টিভি প্রধান নির্বাহী হামিদ মীর লিখিত দৈনিক উর্দু জঙ্গ পত্রিকা থেকে অনুবাদ আমিরুল ইসলাম