ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পাকবাহিনীর হামলার বিবরণ
‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।।
“স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের আর পাঁচটি প্রতিষ্টানের মত ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজেও কাজ চলছে পূর্ণোদ্দমে। ছাত্রদের পদাভরে কলেজ আজ সরগরম। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা বর্বর পাকবাহিনী তাচ্ছিল্যভাবে নষ্ট করে দিয়েছিল তা এক এক করে জোগাড় করা হচ্ছে,কলেজের শ্রীবৃদ্ধির জন্য নিরলস চেষ্টা চলছে। সবই একদিন হয়ত হবে। আর সব অভাবই একদিন পূর্ণ হবে। কিন্তু পূরণ হবে না কয়েকটি নিবেদিত প্রাণের অভাব, এরা ফিরে আসবেন না। এরা হচ্ছেন অধ্যাপক লেঃ কর্ণেল মঞ্জুরুর রহমান,অধ্যাপক হালিম খান, মালি আব্দুস সাত্তার ও চৌকিদার সইজদ্দীন।
এদের মর্মান্তিক মৃত্যের কাহিনী বলতে গেলে আরও একটু গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। ২৫ তারিখের রাতে ঢাকার বুকে ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর যখন ঝিনাইদহ পৌঁছল তখন ঝিনাইদহের জনসাধারণের সাথে সাথে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের সকল শ্রেণীর কর্মচারীরাও দেশের জন্য সংগ্রাম করার বলিষ্ঠ শপথ নিল। সে সময় বর্তমান প্রবন্ধকার আব্দুল হালিম খান (মরহুম) ও অধ্যাপক শফিকুল্লার (বর্তমান ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে ক্যাডেট কলেজ প্রতিরক্ষা দল গড়ে তোলা হলো এবং ঝিনাইদহের সেসময়ের এস.ডি.পি. ও জনাব মাহবুব উদ্দিন (বর্তমান মেজর ও বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি) এর সাথে যোগা্যোগ স্থাপন করা হয় (ইনি প্রথমে ঝিনাইদহ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেন চূয়াডাঙ্গাসহ সাবেক ই.পি.আর এর মেজর আবু ওসমান এর নির্দেশ মত কাজ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন ও পরে মুজিব নগর থেকে মেজর পদে উন্নীত হন)।
এরপর ৩০ মার্চ গভীর রাতে কুষ্টিয়া থেকে পাক বাহিনীর ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি সৈন্য যখন অতি সন্তর্পনে ঝিনাইদহের নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণের উপর তাদের হিংস্র নখরঘাতের জন্য মরণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিলো,তখন ঝিনাইদহে শুধু ক্যাডেট কলেজের মুষ্টিমেয় সংগ্রামী বীর ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরাই রাত ২ টায় তাদের প্রতিহত করে। এরপরে এই হানাদার দলকে বাংলার যে বীর সৈনিকরা নির্মূল করে তাদের অধিকাংশই ছিল এই কলেজের কর্মচারী।
এরপর ১লা এপ্রিল যখন যশোহর থেকে আগত সেনারা নতুন করে ঝিনাইদহ দখলের ব্যর্থ চেস্টা করে তখন তাদেরকে ঝিনাইদহ এর ছমাইল দূরে বিষয়খালিতে যে বাধা দেওয়া ও পর্যুদস্ত করা হয় তাতেও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ও অন্যান্য শ্রেণীর কর্মচারী দের দান অপরিসীম। শুধু যুদ্ধ করাই নয়,নতুন্দের শিক্ষা দেওয়া,সংবাদ সরবরাহ, মুক্তিবাহিনীরর রসদ যোগানোর দায়িত্ব নেয় এই কলেজের কর্মচারীরা। ৫ শত মুক্তিযোদ্ধার খাবার তৈরি করার ভারও নেয় এই কলেজের কর্মচারীরা , অবশ্য সেসব কথার অবতারণা অন্যত্র করা যাবে।
এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক,এরপর জয়ে- পরাজয়ের মাঝে চললো কিছুদিন। কখনো মুক্তিবাহিনী যশোহরের দিকে এগিয়ে যায় আবার পিছিয়ে আসে। এদিকে হানাদার বাহিনী প্রতিদিনই বিমানযোগে যশোরে প্রচুর গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ও নতুন সৈন্য সমাবেশ করে ফেললো। সেসময় মেজর আবু ওসমান সাহেবের নির্দেশ এ ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন মুক্তিবাহিনী কে close up করে ভারতে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন পড়ে রইল অরক্ষিত অবস্থায়। পাক বাহিনী ফাঁকা মাঠ পেয়ে বীরদর্পে ঝিনাইদহ প্রবেশ করল ১৬ই এপ্রিল।
এসময় এ মহতি প্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অন্যান্য সবাই প্রাণের মায়ায় কলেজ ত্যাগ করে চলে গেলেও কয়েকটি প্রাণী এ কলেজ ত্যাগ করেননি। সম্ভবত এই কলেজের মায়ায়। এই প্রতিষ্টানের সব কিছুকে অক্ষত রাখার জন্যই তাদের ব্যর্থ চেষ্টা, এদেরই একজন চৌকিদার গাজি হলেন হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত প্রথম প্রথম বীর সৈনিক। অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান তাকে নিজ সাইকেল দিয়ে পাটিয়েছিলেন ঝিনাইদহের অবস্থা দেখে আসতে। কর্তব্যনিষ্ঠ এ মহাপ্রাণ লোকটি তার দায়িত্ব পালন করতে যখন ঝিনাইদহ শহরের দিকে এগুচ্ছিলো তখন হানাদার বাহিনী নির্মম বুলেট এসে তার বক্ষ বির্দীকরে দেয়। তার প্রাণহীন গড়িয়ে পড়ে ক্যাসেল ব্রীজের তলায়,পরে বর্বর বাহিনী তার পবিত্র দেহ আরও বহু দেশপ্রেমিক বাঙ্গালির পবিত্র দেহের সাথে রাস্তা তৈরির কাজে লাগায়,আজও ক্যাসেল ব্রীজের পাশে রাস্তা খুঁড়লে অনেক কঙ্কাল পাওয়া যাবে।
এরপর ঐদিন বেলা চারটায় হানাদার বাহিনী কলেজ অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান (মরহুম),অধ্যাপক আব্দুল হালিম খান(মরহুম), ইলেক্ট্রিশিয়ান মোহাম্মদ আলি,ও অধ্যক্ষের বার্বুচি আবুল ফজলকে ধরে নিয়ে যায়। আর্মির একজন সিনিয়র অফিসারকে সামান্যতম সম্মানও তারা দেখায়নি। অন্যান্যদের সাথে তাকেও তারা হাত বেঁধে নিয়ে যায়। বিভিন্ন ক্যাম্পের বিভিন্ন লোকের কাছে তারা লাঞ্চিত হন। এদেরকে এরা নির্মম ভাবে প্রহার করে।
এরপর প্রহসনস্বরূপ অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তদানিন্তন যশোহর গ্যারিসন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার দূররানীর কাছে। ব্রিগেডিয়ার তাদের চা পরিবেশন করেন। মৌখিক ভদ্রতা ও দেখালেন এবং সর্বোপরি ক্ষমা প্রদর্শন করে রাত বারটায় কলেজ গেটে পৌছে দেওয়ালেন। ক্লান্ত অবসন্ন ক্ষুধার্ত চারটি প্রাণী কলেজে এসে সে রাতের মত মসজিদে আশ্রয় নিলেন। পরের দিনটা ভালই কাটল।
এরপর এলো ১৮ ই এপ্রিল। কলেজে মাত্র চারটি প্রাণী আছেন। অধ্যক্ষ, অধ্যাপক হালিম খান,বাবুর্চি আবুল ফজল ও হসপিটাল এটেন্ডেন্ট শামসুল আলম, চারদিকে জনপ্রাণহীন,খাঁ খাঁ করছে। একটা থমথমে ভাব মাঝে মাঝে এ স্তব্ধতা ভেঙ্গে ঝিনাইদহ -কুষ্টিয়া সড়কে দ্রুতগামী আর্মির গাড়ির আওয়াজ। একটা অমঙ্গলের ছাপ যেন চারদিকে বিরাজ করছে। সবেমাত্র অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান ও অধ্যপক হালিম খান দুপুরের খাবার খেয়ে অধ্যক্ষের বাংলোর উপর তলায় বিশ্রামের জন্য গেছেন। যাবার সময় হসপিটাল এটেন্ডেন্টকে তাদের দুজনাত জন্য ঔষুধ আনিতে বলে গেছেন (আগের দিনের প্রহারে দুজনারই নাক মুখ ফুলে গিয়েছিল ও কানে ব্যথা হয়েছিল)। হসপিটাল এটেন্ডেন্ট সবেমাত্র সাইকেলে করে অধ্যক্ষের বাংলো গেট পার হয়ে কিছু দুর গেছে। এমন সময় পেছনে ১ নম্বর গেট ভেঙ্গে কয়েকটি আর্মি ট্রাক কলেজে ঢুকে পড়ে এবং অধ্যক্ষের বাংলোর দিকে এগিয়ে যায়।এই দলটি আসছিল কুষ্টিয়া থেকে,এদের অধিনায়ক ছিল ১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইকবাল। এই নরপিশাচএর আদেশে জওয়ানরা অধ্যক্ষকে,অধ্যাপক হালিম খান ও বাবুর্চি আবুল ফজলকে ঘর থেকে বের করে গেটের নিচে বসায়। হানাদার বাহিনীর সাথে ছিল তাদের চর কয়েকজন বিহারী। এদের মধ্যে সব চাইতে বেশী উদ্যোগী ছিল ঝিনাইদহএর টমেটো নামে পরিচিত বিহারিটি। এই নরপিশাচ অধ্যাপক হালিম খান ও অধ্যক্ষ কর্নেল রহমানের নামে তাঁর পরিবারবর্গ নিধনের মিথ্যা অপবাদ দেয়। আর এই মিথ্যা অপবাদের উপর ভিত্তি করেই ক্যাপ্টেন তার অনুচরদের হাতে ছেড়ে দেয় অধ্যাপক হালিম খানের প্রতিশ্রুতিশীল জীবন। অধ্যক্ষের বাংলোর পিছনে এরা অসহায় হালিম খানকে বেয়োনেট আর তলোয়ার এত নির্মম আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। অধ্যক্ষ এক সময় গর্জে উঠলেন, Don t torture him, ifyou want to kill him, better shoot।তাঁদের এই নির্মম আঘাতে এক সময় এই নির্ভীক দেশপ্রেমিকের বিশাল দেহ এই দেশের পবিত্র ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে।
তারপর চলে এই হত্যাযজ্ঞের আর এক অধ্যায়। অধ্যক্ষকে ঐ একই অপবাদ। তারপর নরপিশাচ ক্যাপ্টেন ইকবাল এর সাথ কথা কাটাকাটি হয়। কর্ণেল বলেন, “আমি আর্মি অফিসার, আমাকে এমনি মারা অন্যায়। আমার অপরাধের বিচার একমাত্র সামরিক আদালতই করতে পারে।”প্রশ্ন করলেন,”একজন আর্মি কর্ণেল, একজন ক্যাপ্টেন এর কাছ থেকে যে মর্যাদা পেতে পারে,আমাকে তা দেওয়া হচ্ছে না কেন?
কিন্তু এই নরপিশাচদের কাছে সকল যুক্তি বৃথা গেলো। সিংহ হৃদয় মহাপুরুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন হাত থেকে খুলে দিলেন ঘড়ি পকেট থেকে বের করে দিলেন নিজের ও কলেজের চাবি যা এতদিন ছিল তার দায়িত্বে। নিজের চোখে দেখলেন একজন সিপাই তারই চোখের সামনে থেকে তারই ঘড়ি নিয়ে নিজের হাতে পরে ঘড়ি পরা হাতটা কেমন লাগে তাই লোলুপ দৃষ্টিতে নাড়ে চেড়ে দেখছেন।
দেখলেন জোওয়ানরা উল্লাসের সাথে এর দামি জিনিসপত্র ও কলেজের মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকে তুলছে।এই মহাপুরুষের কোন ভাবান্তর হলো না,আত্নপক্ষ সমর্থনের চেস্টা করলেন না। করলেন না করুণা ভিক্ষা, অমূল্য ধনপ্রাণ ভিক্ষাও চাইলেন না। শুধু চাইলেন পাঁচ মিনিটের সময়। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন বাংলোর সামনের লনে,বসলেন গিয়ে গোলাপ গাছের পাশে, কি যেন বিড় বিড় করে পড়লেন,বোঝা গেল না-শুধু ঠোঁট নাড়া দেখে বোঝা গেল,তারপর হাততুলে আল্লাহর কাছে কি যেন ফরিয়াদ করলেন,মোনাজাত শেষে করে বললেন,I am ready,এরপর কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো গুডুম গুডুম গুডুম তিনটা আওয়াজ, নরপিশাচ মানবজাতির কলংক ইয়াহিয়ার সৈনিক ইকবালের স্টেনগানের তিনটা গুলি এক এক করে এই পবিত্র দেহে বিদ্ধ হল। শরীরটা ঢলে পড়লো।আর শোনা গেল একটি মাত্র ক্ষীণ স্বর, ” মা আয়েশা,তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না”।
এরপর প্রাণভরে লুটে নিল কলেজের দামী দামী জিনিসপত্র, বাঁধা দেওয়ার কেউ রইল না। তারপর তারা যখন উল্লাস করতে করতে ২ নং গেট দিয়ে বের হচ্ছিল সেসময় তাদের নজর পড়লো গেটে কর্তব্যরত মালী সাত্তারের উপর। তাকে তারা ধরে নিয়ে ড্রেনের পাশে দাঁড় করিয়ে পর পর দুটো গুলি করে হত্যা করলো, গুলি দুটো তার দেহ ভেদ করে দেওয়ালে বিদ্ধ হলো। তার দেহ এলিয়ে পড়লো ড্রেনের মধ্যে, এত করেও শান্তি পেল না, আশেপাশের গ্রামে খুঁজতে লাগলো কলেজের চাকুরে কে কোথায় আছে। এমনি এক গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসলো হতভাগ্য চৌকিদার সইজুদ্দিন কে।তাকে ধরে নিয়ে এসে কলেজের সামনে ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কের পুলের তলায় দাঁড় করিয়ে গুলি করলো তার প্রাণহীন দেহ পুলের তলায় পড়ে রইল। এমনি কত জানা অজানা লোকের রক্তের স্রোতের উপর ভেসে স্বাধীনতার তরী আমাদের কাছে নতুন জীবনের সওগাত নিয়ে এসেছে। তাদের রক্ত বিফল যায়নি। যেতে পারে না। কেননা স্বাধীনতার রক্তকে উন্নত ও সজীব রাখতে সারের প্রয়োজন হয়। আর সে সার হচ্ছে অত্যাচারীর ও অত্যাচারীতের তাজা উষ্ণ লাল রক্ত।“