পাঠকের কথা

বৈষম্যের শুরু ঘর থেকেই……শামীমা রহমার শিমু

বৈষম্যের শুরু ঘর থেকেই……গল্পটি লিখেছেন ঝিনাইদহের শামীমা রহমার শিমু

সারা রাত তীব্র প্রসব যন্ত্রনার সাথে যুদ্ধ করার পর ভোরের আলোর সাথে পৃথিবীর বুকে নতুন একটি প্রাণের আগমন হল, এক ফুটফুটে কন্যা শিশুর, নাম জয়ী।জয়ীর বাবা সকালে হাসপাতালে ছুটে এলেন স্ত্রীর খবর নিতে। অনেক রাত অপেক্ষার পর বাড়ি ফিরে যান। হাসপাতালের বারান্দাতে পা দিতেই নার্সরা তাকে সুসংবাদ দিলেন।
—“আপনার প্রথম কন্যা সন্তান হয়েছে, আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন”

জয়ীর বাবার ভেতর এক পুত্র সন্তানের অভাব হাহাকার করে উঠলো।মুখটা মলিন করে মেয়েকে এক নজর দেখে চলে গেলেন কারো সাথে কোন কথা না বলেই।পরের তিন দিন মা-মেয়েকে দেখতে আসলেন না। জয়ীর মা রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে, অভিমানে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন ভাইয়ের বাড়ি। জয়ীর মামাদের তখন সংসারে টানাটানি।ভরা পৌষ মাস, হাঁড় কাপানো শীত। ভাইয়ের নড়বড়ে ঘরে জয়ীকে নিয়ে থাকলেন দীর্ঘ তিন মাস। জয়ীর মামাদের তেমন টাকা না থাকলেও ভালবাসা যত্নের কমতি ছিলনা ভাগ্নির জন্য। জয়ী তার মায়ের বংশের প্রথম কন্যা সন্তান। জয়ীর বাবা ৩ মাস মেয়েকে একবারের জন্য দেখতে না আসলেও মেয়ের প্রতি কর্তব্যে কোন হেলা করেননি। ৩ মাস পর যখন অভিমান বিচ্ছেদের সুরে ডুবে যাবে যাবে করছে তখন জয়ীর বাবা তার মাকে পাঠিয়ে বউ-মেয়েকে নিজের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলেন।সব কিছু স্বাভাবিক হলে হয়তো অভিমান কষ্টের বোঝা জয়ীকে এখনো বয়ে বেড়াতে হতে না। সব হয়ে ও হল না শেষ। বাবা তার মেয়ের মুখ দেখেনা, কোলে নেয় না। দোতলা বাড়ির নিচে জয়ী ওর মার সাথে থাকতো আর বাবা উপরে। জয়ীর বাবা-মায়ের ভেতরেও কথা বন্ধ থাকলো, এমনকি মুখ দেখাও বন্ধ দুজনের। এভাবে ৭ মাস চলার পর পাশের বাড়ির এক বড় ভাবী এসে একদিন সকালে জয়ীকে তার বাবার কোলে জোর করে তুলে দিলেন। জয়ী ততদিনে বেশ বড়, চঞ্চল আর মিষ্টি চেহারার অধিকারী হয়ে উঠেছে। বাবা তাকে দেখে আর চোখ ফেরাতে পারেননি।বাবা আর মেয়ের সম্পর্কের শুরু সেখান থেকেই। আস্তে আস্তে জয়ীর বাবা-মায়ের সম্পর্কটাও সুন্দর হয়ে গেল। জয়ীকে তার বাবা নিজের আজান্তেই ভালবাসতে শুরু করেছিলেন আর জয়ী ও ছিল বাবা ভক্ত মেয়ে। তার সব দুষ্টামি, চঞ্চলতা, আধবুলি তার বাবাকে মুগ্ধ করতে লাগলে। এর বছর দেড়েক পর জয়ীর মা দ্বিতীয় বারের মত সন্তান সম্ভবা হলেন। এবার পরম করুণাময় আল্লাহ্- তায়ালা জয়ীর বাবাকে বংশের প্রদীপ দ্বান করলেন, এক পুত্র সন্তান। জয়ীর বাবার সমস্ত কষ্ট, অভাববোধ অবশেষে দূর হল। তার মুখে বিজয়ের হাসি। এবং সে এতটাই খুশি হলেন ছেলের মুখ দেখে, এরপর নিজেই মা-ছেলেকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতেই ওঠালেন। যেদিন তার বংশের প্রদীপ বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখলো, সেই দিন দুটো সোনার চুড়ি জয়ীর মায়ের হাতে পরিয়ে দিলেন। জয়ী সেদিন ছোট ছিল ভাগ্যিস!! সেইদিন ঐ কন্যা শিশুটা বুঝতে পারিনি কত হতভাগিনী সে! কত বড় বৈষম্যের শিকার হয়েছে বাচ্চাটা। আজ ও জয়ী ভুলতে পারেনা এই বৈষম্য। এখনও বয়ে বেড়ায় বৈষম্যের বোঝা। জয়ী নিজেই এখন একজন কন্যা সন্তানের মা। নিজে ভুক্তভোগী বলেই নিজের মেয়েকে সব সময় আগলে রাখে সেই দুনিয়াতে আসার প্রথম দিন থেকেই। অবসরে সেই ছোট্ট জয়ীর চোখে যখন ভাসে সেই ভেদাভেদ, তার গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসে।

সে আজও করতে পারেনি প্রশ্ন তার বাবাকে—
“ কেন বাবা ?মেয়েটি জীবনের প্রথম দিন থেকে আজ অবদি বয়ে বেরাচ্ছে শত শত হাজার কষ্ট “
আজ সে পাহাড় জয়ী কারণ কষ্টগুলো জমতে জমতে পাহাড় সমানই হয়ে গেছে। সমাজ থেকে শুরুটা হয়না, সব কিছুর উৎপত্তির জন্মস্হানই হল ঘর।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button