ধর্ম ও জীবন

শাওয়ালের নফল ছয় সাওমের ফযিলত

ঝিনাইদহের চোখঃ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

‘সাওম’ আরবি শব্দ, এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিরত থাকা’। শরী’আতের পরিভাষায়, বিশুদ্ধ নিয়তের সহিত সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া, পান করা, স্ত্রী সহবাস, কাম–ক্রোধ, লোভ-মোহ, রিপু ইত্যাদি চাহিদা ও কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখাকেই ‘সাওম’ বলা হয়।

সিয়ামের প্রকারভেদ-

সিয়াম প্রথমত চার প্রকার যথা- ফরজ, নফল, হারাম ও মাকরূহ।

নফল সিয়ামের বর্ণনা-

‘নফল’ শব্দের অর্থ অতিরিক্ত কাজ।

ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য এবং প্রশংসিত অবস্থান লাভ করার জন্য মানুষ ফরজ ইবাদতের পরও সঠিক পদ্ধতিতে কুরআন সুন্নাহর আলোকে অতিরিক্ত যে ইবাদত করে থাকেন তাহাকে নফল ইবাদত বলা হয়।

নফলের হকুম-

নফল রোযা রাখলে সাওয়াব পাওয়া যাবে, না রাখলে গুণাহ্ নেই কিন্তু নফল ইবাদাত পালন করার ব্যাপারে আল্লাহ্ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্‌ বলেন- “আর রাতের কিছু অংশে কুরআন পাঠসহ তাহাজ্জুদ আদায় করুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। আশা করা যায়, আপনার পালনকর্তা আপনাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৯)

উল্লেখিত আয়াত দ্বারা বুঝা গেল নফল ইবাদাত পালন করতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- নফল নামায, নফল দান খয়রাত, নফল রোযা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে সূরা বাকারার ১৮৪ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে- অবশ্য কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পুণ্যের কাজ করে (এবং নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেয়) তবে তার পক্ষে তা কল্যাণকর এবং তোমরা যদি বুঝে থাক তাহলে সিয়াম পালনই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কোন মহিলা স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতিত রমজানের ফরজ রোযা ছাড়া কোনো নফল রোযা রাখবে না।

নফল সিয়ামের প্রকারভেদ-

নফল সিয়াম কয়েক প্রকার।

(১) শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা।

(২) জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন বিশেষ করে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকারী হাজীগণ ছাড়া সাধারণ মুসলমানদের জন্য আরাফাতের দিন রোযা।

(৩) মুহাররম মাসের রোযা। বিশেষ করে আশুরার দিন ও তার আগের বা পরের দিন সহ।

(৪) শাবান মাসের বেশির ভাগ অংশ সিয়াম পালন করা।

(৫) ‘আশহুরুল হুরুম’ (জিলক্বদ, জিলহজ্জ, মুহাররম ও রজব) মাসের রোযা।

(৬) প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযা।

(৭) প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ (আইয়্যামে বিজ) এর রোযা।

(৮) সাওমে দাউদ (একদিন পর একদিন সাওম রাখা অর্থাৎ একদিন রোযা রাখবে এরপর রাখবে না)।

হারাম সাওম-

(১) দুই ঈদের দুইদিন।

(২) ‘আইয়্যামে তাশরিক’ (কুরবানী ঈদের পর তিনদিন)।

মাকরূহ সাওম-

(১) শুধু জুমআর দিন খাস করে রোযা রাখা।

(২) শুধু শনিবার দিন রোযা রাখা।

সাওমে দাহার-

নিষিদ্ধ দিবসসমূহসহ সারা বছর সাওম বা রোযা রাখা।

মান্নাত সাওম-

কোন বিপদ থেকে মুক্তি লাভ অথবা মনে কামনা বাসনা ও বিভিন্ন চাহিদা পূর্ণ করার জন্য রোজা রাখা।

নফল ইবাদতের গুরুত্ব- ইসলামে নফল ইবাদাতের গুরুত্ব অনেক, যেমন হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহুকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের মাঝে সর্বপ্রথম তার সালাতের হিসাব নেয়া হবে। আর সলাত যদি যথাযথ সঠিক প্রমাণিত হয় তবে সে সাফল্য লাভ করবে। আর যদি সলাতের হিসাবেই খারাপ হয় তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফরয সলাতের হিসেবে যদি কিছু কম পড়ে, তবে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তখন বলবেন তোমরা দেখো, আমার এই বান্দার কোনো নফল সলাত বা নফল ইবাদাত-বন্দেগী আছে কী না, যদি থাকে তাহলে এর দ্বারা ফরযের কমতি পূরণ করো। পরে তার অন্যান্য সব আমালের ব্যাপারে এটিই বিবেচিত ও অনুরূপভাবে কমতি পূরণ করা হবে। (জামে তিরমিযী)

অপর হাদিসে আছে, রাবীআহ্ ইবনু কা’ব আসলামী (রাঃ) বলেন- নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, (আমার নিকট) তুমি (কিছু) চাও।

উত্তরে আমি বললাম, জান্নাতে আমি “আপনার সাহচয্য চাইছি”।

তিনি বললেন, এ ছাড়া আরো কিছু?

আমি বললাম, এটিই।

তখন তিনি বললেন, তবে তুমি বেশি বেশি সিজদাহ দ্বারা (বেশি নফল নামায পড়ে) এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর।(সহীহ মুসলীম)

সুবহানাল্লাহ, হাদীসে নফল ইবাদাতের অনেক মর্তবা রয়েছে। বান্দা তার নফল ইবাদাতের বদৌলতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বসবাস করার সুবর্ণ সুযোগ পাবে।

নফল ৬ রোজা রাখার নিয়ম-

নফল রোযা ভেঙ্গে ভেঙ্গে (একদিন রোযা রেখে ২/১ দিন পরে আবার রোযা রাখা) রাখা যাবে। আবার শাওয়ালের ৬ টি রোযা একসাথে রাখা যাবে। নফল রোযা রেখে দিনের বেলা ইচ্ছাকৃত পানাহার করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কোন রকম কাফফারা দেয়া লাগবে না ও ক্বাজা আদায় করতে হবে না।

শাওয়াল মাসের ৬টি রোযা শাওয়ালের চাঁদের তারিখের ভেতরই রাখতে হবে। তবে শাওয়াওলের প্রথম তারিখে রোযা রাখা হারাম, সে দিনটি ঈদুল ফিতরের দিন। শাওয়ালের রোযা অন্য মাসের চঁন্দ্র তারিখে রাখলে চলবে না।

নফল রোযা রাখলে তারাবির সলাত আদায় করা জরুরী নয় তবে নফল নামাজ বা তাহাজ্জুদের নামাজ, কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করতে পারবে। এছাড়া নফল রোযা ফরজ রোযার নিয়মের মতই রাখতে হয়। নফল রোযা রাখলে সাওয়াব পাওয়া যাবে, না রাখলে গুণাহ্ নেই।

নফল ৬ রোযার ফজিলত-

রোযা আল্লাহর নিকট অত্যান্ত পছন্দনীয় ইবাদাত। ফলে হাদীসে কূদূসীতে রোযাদারের রোযার সাওয়াব তিনি নিজ হাতে দেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা অত্যান্ত কঠোর সাধনা, উপবাস ও আত্মসংযমের মাধ্যমে সিয়ামে রমাযান বা রমাযান মাসের ফরজ রোযা পলন করলাম।

এখন আমাদের নিকট যে চঁন্দ্রমাসটি চলছে তাকে আরবীতে শাওয়াল মাস বলা হয়। এই মাসের রোযা সম্পর্কে প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আবূ আইঊব আনসারী রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা পালন করার পর, শাওয়াল মাসে (ঈদের দিন ছাড়া) ৬টি রোযা রাখবে, তার ঐ রোযা (পুণ্যে) পুরো বছর রোযা রাখার সমতুল্য গণ্য হবে। (সহীহ মুসলীম)

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) নিজে নফল নামজের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাহায্য চেয়েছেন। সাহাবিগণও যখন হাজত পূরণ করতে চাইতেন এবং কঠিন মসিবত থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরভাবে ওজু করে দু’রাকাত নফল সালাত পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাইতেন। কঠিন মসিবত থেকে আল্লাহ্‌ তাদের নাজাত দিতেন। নফল ইবাদতই আল্লাহ্‌র নিকটে সাহায্য পাওয়ার উত্তম মাধ্যম।

সুতরাং, কেউ যদি নিজেকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তার উচিত বেশি বেশি নফল সলাত ও রোযা পালন করা। মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে নফল ইবাদাত করার তাওফিক দান করেন। আমিন।

লেখক : শাইখ শফিকুল ইসলাম, ইসলামি লেখক ও গবেষক। সাবেক প্রিন্সিপাল মারকাজ আবু বাকর সিদ্দীক(রাঃ) কিশোরগঞ্জ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button