ধর্ম ও জীবন

মুসা আঃ. এর জীবনী (পর্ব- ২)

ঝিনাইদহের চোখঃ

মুসা আঃ. এর দাওয়াত-

আল্লাহর নির্দেশে ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের বিরুদ্ধে অলৌকিক লাঠি ও হস্ত তালুর দুটি নিদর্শন নিয়ে মুসা আঃ. মিসরে পৌঁছে ফেরাউন ও তার সভাসদদের নিকট পৌঁছে গেলেন। অতপর মুসা ফেরাউনকে বললেন, হে ফেরাউন! আমি বিশ্ব প্রভুর পক্ষ হতে প্রেরিত রাসূল। আল্লাহর পক্ষ হতে যে সত্য এসেছে তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি দৃঢ়চিত্ত থাকার ঘোষনা প্রদান করছি। আমি তোমার নিকট তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন নিয়ে এসেছি। অতপর তুমি বনি ইসরাঈলগনকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও। (সূরা আরাফ : ৭/১০৫)

তুমি বনি ইসলাঈলদের উপর নিপীড়ন করো না। আমরা আল্লাহর নিকট থেকে ওহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার ওপরে আল্লাহর আযাব নেমে আসে। (সূরা ত্বোয়াহা : ৪৭-৪৮)

একথা শুনে ফেরাউন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মুসা তোমার পালনকর্তা কে? মুসা আঃ. বললেন, আল্লহ। ফেরাউন বলল, তাহলে অতীত লোকদের অবস্থা কী? মুসা আঃ. বললেন, তাদের খবর আমার প্রভুর কাছে লিখিত আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত ও বিস্মৃত হন না। একথা বলার পর মুসা আঃ. আল্লাহর নিদর্শন সমূহ বর্ণনা শুরু করলেন।

তিনি বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং তাতে চলার পথসমূহ তৈরি করেছেন। তিনি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন। তোমরা তা আহার হিসেবে গ্রহণ ও তোমাদের চতুস্পদ জন্তুসমূহ চড়িয়ে থাক। নিশ্চয়ই এতে বিবেকবান মানুষের জন্য পথ নির্দেশনা আছে। (সূরা ত্বোয়াহা)

মুসা আঃ. এর দাওয়াতের সার সংক্ষেপ-

১. বিশ্ব পালনকর্তা আল্লাহর দিকে আহ্বান।
২. আল্লাহর প্রেরিত সত্যই প্রকৃত সত্য। তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার বা না করার ব্যাপারে সর্বদা দৃঢ়চিত্ত থাকার ঘোষনা প্রদান।
৩. আল্লাহর গজবের ভয় প্রদর্শন।
৪. আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্লেষণ।
৫. পেছনের লোকদের হিসাব আল্লাহর উপর ন্যাস্ত করে বর্তমান অবস্থার সংশোধনের প্রতি আহ্বান।
৬. মজলুম বনি ইসরাঈলীদের মুক্তির জন্য জালিম ফেরাউনের নিকট আবেদন।

মুসা আঃ. এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি-

ফেরাউনের অহংকারী হৃদয়ে মুসা আঃ. এর দাওয়াত কোনরূপ রেখাপাত করল না, বরং ফেরাউন পরিষ্কার বলে দিল তোমার এসব অলীক জাদুমাত্র। আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে এসব কথা শুনিনি। (সূরা কাছাছ : ৩৬)

ফেরাউন তার সভাসদগণকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে পরিবার-পরিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানি না। (সূরা কাছাছ : ৩৮) এরপর মুসা আঃ. এর প্রতিশ্রুতি পরকালের গৃহ দেখার জন্য জনগনকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার মন্ত্রীকে বলল, হে হামান! তুমি ইট পোড়াও, অতপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মুসার উপাস্যকে উকি মেরে দেখতে পারি। আমার ধারণা সে একজন মিথ্যাবাদী, একথা বলে ফেরাউন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে অহংকারে ফেটে পড়ল। (সূরা কাছাছ : ৩৯)

ফেরাউন মুসাকে বলল, যদি তুমি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্য রূপে গ্রহণ কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। মুসা বললেন, আমি তোমার কাছে সুষ্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আসলেও কি তুমি আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে? ফেরাউন যখন তাচ্ছিল্যভরে মুসাকে ষ্পষ্ট নিদর্শন দেখাতে বলল।

তখন মুসা নিজের হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করলে তা একটি জলজ্যান্ত সাপে পরিণত হয়ে যায়। তারপর তার বগলের নীচ হতে হাত বের করলে তা সংঙ্গে সংঙ্গে দর্শকদের চোখের সামনে ধবধবে আলোকোজ্জ্বল দেখাতে লাগল। (সূরা শুআরা : ১৮-৩৩)

জাদুকরদের মোকাবেলা-

মুসা আঃ. ও ফেরাউনের মাঝে জাদু প্রতিযোগিতার দিন ধার্য হবার পর মুসা আঃ. নবীসুলভ দয়া প্রকাশ করে নেতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, দুভোর্গ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দিবেন। যারা মিথ্যাআরোপ করে তারা বিফল মনোরথ হয়।

অতপর তারা তাদের কাজে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল এবং গোপনে পরামর্শ করল। তারা বলল, এই দুইজন লোক (হারুন ও মুসা) নিশ্চিতভাবেই জাদুকর। তারা তাদের জাদুর মাধ্যমে আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিস্কার করতে চায় এবং উৎকৃষ্ট জীবনধারা রহিত করতে চায়। অতপর সারিবদ্ধভাবে এসো, আজকে যে জয়ী হবে সে সফলকাম হবে।

জাদুকররা উৎসাহিত হয়ে মুসা আঃ. কে বলল হে মুসা! হয় তুমি তোমার জাদুর লাঠি নিক্ষেপ কর না হয় আমরা প্রথম নিক্ষেপ করি। (সূরা ত্বোয়াহা : ৬১-৬৫)

মুসা আঃ. বললেন তোমরাই আগে নিক্ষেপ কর, অতপর যখন তারা তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাধিয়ে দিল এবং ভীত-সন্ত্রোস্ত করে তুলল, এক মহা জাদু প্রদর্শন করল। (সূরা শুআরা : ৪৪, আরাফ : ১১৬)

এমতাবস্তায় আল্লাহ মুসা আঃ. কে অভয় দিয়ে বললেন, তুমিই বিজয়ী হবে, তোমার ডান হাতে যা আছে তা (লাঠি) নিক্ষেপ কর এটা তাদের সবকিছুকে যা তারা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। ওদের ওসব তো জাদুর খেলা মাত্র। জাদু যেখানে থাকুক তারা সফল হবে না। (সূরা ত্বোয়াহা : ৬৮-৬৯)
মুসা আঃ. আল্লাহর নামে লাঠি নিক্ষেপ করলেন, দেখা গেল তা বিরাট সাপের ন্যায় রূপ ধারণ করল এবং জাদুকরদের সমস্ত অলীক র্কীতিগুলোকে গ্রাস করলো। (সূরা শুআরা : ৪৫)

জাদুকরদের ইসলাম গ্রহণ-

এই দৃশ্য দেখে তৎকালীন যুগশ্রেষ্ট জাদুকরগণ বুঝে নিল হঠাৎ করে কেউ বিশ্ব সেরা জাদুকর হতে পারে না। কেননা মুসা ও তার ভাই আমাদের সমাজেই বসবাস করেছে এবং তাদেরকে কখনও জাদু শিখতে শুনিনি বা দেখিনি। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অলৌলিক কোন সত্তার নিদর্শন রয়েছে, যা আয়ত্ত করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে।

এসময় মুসা আঃ. এর দেওয়া তওহীদের দাওয়াত ও আল্লাহর গজবের ভীতি তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল। অতপর জাদুকরেরা বলল, আমরা বিশ্বচরাচরের পালনকর্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যিনি মুসা ও হারুনের রব। (সূরা আরাফ : ১১৮-১২১)

ফেরাউনের স্ত্রীর ঈমান আনয়ন-

ফেরাউনের নেক্কার স্ত্রী ও মুসা আঃ. এর পালক মাতা ‘আছিয়া’ হারুন ও মুসা আঃ. এর বিজয়ী সংবাদ শুনে কালবিলম্ব না করে বলে উঠলেন, আমি মুসা ও হারুনের পালনকর্তার উপর ঈমান আনলাম। তখন ফেরাউন নিজের স্ত্রীর ঈমান আনয়নের খবর শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে। (সূরা ত্বোয়াহা : ৭২-৭৬)

মৃত্যুর পূর্বে আছিয়া আল্লাহ নিকট কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করেন, হে আমার পালকর্তা! তোমার নিকট জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর নির্মান কর। আমাকে ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের হাত থেকে উদ্ধার কর। (সূর আত-তাহরীম : ১১)

নবী (সাঃ) বলেন, সারা বিশ্বের নারীদের মধ্যে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া, মারিয়াম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ ও ফাতিমা বিনতে মুহামম্দ সাঃ (এর আদর্শ) যথেষ্ট। (তিরমিযী, হা-৩৮৭৮)

চলবে……

লেখক : মাওলানা আখতারুজ্জামান খালেদ, সাবেক ইমাম ও খতীব, দুপ্তারা, কুমারপাড়া, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button