ধর্ম ও জীবন

সফর মাস ও আখেরি চাহার শোম্বা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা

ঝিনাইদহের চোখঃ

সফর মাস সংক্রান্ত জাল, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথাগুলোর ভিত্তিতেই কিছু ভিত্তিহীন নামাজের প্রচলন করা হয়েছে। বলা হয়েছে-

ক) সফর মাসের প্রথম তারিখে রাত্রে এশার পর ৪ রাকাআত নামাজ – ১ম রাকআতে সূরা কাফিরুন ১৫বার, ২য় রাকআতে সূরা ইখলাস ১৫বার, ৩য় রাকআতে সূরা ফালাক ১৫বার এবং ৪র্থ রাকআতে সূরা নাস ১৫বার পড়তে হবে। এতে সারা বছরের সকল বালা-মুসিবত থেকে রেহাই পাওয়া যায় এবং খুব বেশি নেকি লাভ হয়।

খ) এই মাসের শেষ বুধবার আখেরি চাহার শোম্বার চাশতের (সকাল ৮টা হতে ১০টার মধ্যে) ২ রাকআত নামাজে প্রত্যেক রাকাআতে সূরা ইখলাস ১১বার পড়তে হবে।

গ) সফর মাসের ১ম জুমুআর রাত্রে এশার পর ৪ রাকআত নফল নামাজ পড়তে হবে।

এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। যদিও অনেক সরল প্রাণ আলিম ও বুজুর্গগণ এগুলো বিশ্বাস করেছেন এবং তাদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন ও ওয়াজে প্রচার করেছেন। (খাজা নিযামউদ্দিন আউলিয়া, রাহাতুল কুলূব : ১৩৮-১৩৯পৃঃ., মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফজিলত- ১৪ পৃঃ.)

তবে আমাদের দেশে আখেরি চাহার শোম্বার প্রসিদ্ধ এ জন্য নয় বরং এ জন্যই প্রসিদ্ধ হয়েছে যে, রাসূল সাঃ. সফর মাসে শেষ বুধবার কিছুটা সুস্থ এবং গোসল করেন। অতঃপর তিনি কিছু খাবার খেয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাজে ইমামতি করেন এবং উপস্থিত লোকদের উপদেশ দেন। এ বিষয়ে প্রচলিত কাহিনীর সারসংক্ষেপ হল নবী সা. সুস্থ হলে সাহাবীগণ অত্যাধিক আনন্দিত হয়ে আবু বাকার রা. কে ৭ হাজার দিনার, উমার রা. কে ৫ হাজার দিনার, উসমান রা. কে ১০ হাজার দিনার, আলী রা. কে ৩ হাজার দিনার এবং আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. কে ১০টি উট ও ১০টি ঘোড়া আল্লাহার ওয়াস্তে দান করেছিলেন।

তখন থেকে মুসলামগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরন করে আসছে। (মুফতি হাবিব ছামদানী, বার চান্দের ফজীলত- ১৫পৃ.) নবী (সা.) সফর বা রবিউল আওয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তেকাল করেন সে বিষয়ে হাদিস গ্রন্থে কোনো উল্লেখ নেই। অগণিত হাদিসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থ থাকাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, ইন্তেকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। ২য় হিজরী শতক থেকে আলীমগণ তাঁর জীবনের ঘটনাবলী, ঐতিহাসিক দিন-তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন।

কী বার থেকে তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন, কতদিন অসুস্থ ছিলেন এবং কোন তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেছেন এ সকল বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। সর্বাবস্থায় কেউ কোনভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনোদিন সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ বুখারীতে আয়েশা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে। (সহীহ বুখারী – ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০)

এ গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটে ছিল, তা হাদিসে কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনূ হাজার আসকালানী রা. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদিসের সাথে সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তেকালের আগের বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ ইন্তেকালের ৫ দিন আগে।

১২ রবিউল আওয়াল ইন্তেকাল হলে গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ৮ রবিউল আওয়াল। উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার বা আখেরি চাহার শোম্বায় রাসূল সা. এর গোসল দেওয়া, সুস্থ হওয়া, ইমামতি করার ও লোকদের উপদেশ দেওয়া এবং সাহাবীগণ আনন্দিত হয়ে দান সদাকাহ করার কাহিনীর কোনরূপ ভিত্তি নেই।

যেহেতু মূল ঘটনাটিই প্রমাণিত নয় সেহেতু সে ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে কোনো উৎসব উদযাপন করা বা পালন করার প্রশ্নই ওঠে না। আল্লাহই ভাল জানেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button