ঐতিহাসিক কামান্না দিবস আজ, শহীদ হন ২৭ জন বীরমুক্তিযোদ্ধা
ঝিনাইদহের চোখঃ
ঐতিহাসিক কামান্না দিবস আজ ২৬ নভেম্বর। শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি!!
২৬ নভেম্বর ১৯৭১’র আজকের এই দিনে ঝিনাইদহের শৈলকুপার কামান্না গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হন ২৭ জন মুক্তি পাগল বীরমুক্তিযোদ্ধা।
কামান্না যুদ্ধে যে ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তারা হলেন-শহীদ খোন্দকার রাশেদ আলী (শিবরামপুর, মাগুরা), শহীদ আব্দুল মোমিন উদ্দীন (ফুলবাড়ি, মাগুরা), শহীদ মো. কাদের বিশ্বাস (মোর্তোজাপুর, শ্রীপুর), শহীদ মোঃ শহীদুল ইসলাম (পশ্চিম বেরেইলা, মাগুরা), শহীদ মো. ওয়াহিদুজ্জামান (ফুলবাড়ি, মাগুরা), শহীদ রিয়াত মন্ডল (আলীধানী, মাগুরা), শহীদ আব্দুল মোতালেব (ইছাখাদা, মাগুরা), শহীদ আলী হোসেন (আরালিয়া, মাগুরা), শহীদ শরিফুল ইসলাম (কালা লক্ষীপুর, ঝিনেদা), শহীদ মুন্সী আলীমুজ্জামান ওরফে আরিফ মুন্সী (বিষ্ণুপুর, মাগুরা), শহীদ মো. গোলাম কওসার মোল্লা (মির্জাপুর, মাগুরা), শহীদ মনিরুজ্জামান খান ওরফে মনি খাঁ (হ্নদয়পুর, মাগুরা), শহীদ সেলিম ওরফে কেটে (শিবরামপুর, মাগুরা), শহীদ হোসেন আলী (শ্রীমন্তপুর, মাগুরা), শহীদ গোলজার খাঁ (মালিগ্রাম, মাগুরা), শহীদ আনিসুর রহমান (আরিয়াকান্দি, মাগুরা), শহীদ অধীর কুমার শিকদার (হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ তাজুল ইসলাম তাজু (পারনান্দুয়ারী ব্যাপারীপাড়া), শহীদ গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ আলমগীর ( হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রাজা (দাইরপুল, মাগুরা), শহীদ আকবর (অজ্ঞাত), শহীদ সালেক মোল্লা (দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), শহীদ সলেমান শিকদার (নরসিংহাটি, মঘি, মাগুরা), শহীদ মাছিম মিয়া (হ্নদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ মুন্সী আব্দুর রাজ্জাক রাজা (বারইপাড়া, শ্রীকোল, মাগুরা), শহীদ নিখিল কুমার মন্ডল (বাগডাঙ্গা, মাগুরা)।
শুধুমাত্র গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক রাজা (এফএফ) একদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন। পরে দাইরপোল নিজবাড়িতে তাকে দাফন করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর থেকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দিনটিকে কামান্না দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতি বছর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় দিনটিকে স্মরণ করে সর্বস্তরের মানুষ। শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শৈলকুপাবাসী।
উপজেলা সদর হতে ১৬ কিলোমিটার দূরে অজপাড়াগাঁ ‘কামান্না’। অবস্থানগত সুবিধার কারণে যুদ্ধ চলাকালীন গ্রামটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ নভেম্বর রাতে ৪২ জনের একদল চৌকস রণকৌশলী মুক্তিপাগল যোদ্ধা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক অবস্থান নেন কামান্নার মাধবচন্দ্রের পরিত্যক্ত বাড়িতে। কামান্নায় অবস্থান করা ৪২ মুক্তিযোদ্ধার অধিকাংশ বাড়ি পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর থানা ও মাগুরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় এবং বাকিদের শৈলকূপায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর গোপন থাকে না। স্থানীয় রাজাকারদের তৎপরতায় খবরটি পৌঁছে যায় ঝিনাইদহ ও মাগুরার হানাদার ক্যাম্পে। হানাদাররা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ নভেম্বর রাতের শেষ প্রহরে চারদিক থেকে ভারী অস্ত্রে-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘিরে ফেলে কামান্নার অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটিটি। সময় না দিয়ে হঠাৎ করেই সার্চ লাইট নিক্ষেপ করে বৃষ্টির মতো গুলি চালানো শুরু করে। আকস্মিক আক্রমণে ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধারা হকচকিয়ে যান। এক পর্যায়ে নিজেদের সামলে নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। হানাদারদের ভারী অস্ত্র-সস্ত্রের কাছে সামান্য কিছু স্টেনগান-মেশিনগান নিয়েও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান ২৭ নভেম্বর ভোর রাত পর্যন্ত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আর শেষ রক্ষা হয়নি। এদিন সম্মুখ সমরে শহীদ হন ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের লাশের উপর পৈশাচিক উন্মাদনা করতে করতে এলাকা ছাড়ে হানাদাররা। যাওয়ার সময় গ্রামটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা।
মাগুরা জেলার শিবরামপুর গ্রামের খোন্দকার আব্দুল মাজেদ মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন প্রতিষ্ঠা করেন মাগুরা সদর থানা সম্লিলিত মুক্তিবাহিনী বা মাজেদ বাহিনী যেটা শ্রীপুর বাহিনীর একটা উপবাহিনী হিসেবে পরিচিত। যুুদ্ধকালীন সময় সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী বা মাজেদ বাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে খোন্দকার আব্দুল মাজেদ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মাজেদ সাহেবের বড় ছেলে খোন্দকার রাশেদ আলী ছাত্র অবস্থায় নিজের পিতার বাহিনীতে যোগদান করে কামান্নাতে শহীদ হন। এই দলটি কমান্ডার ছিলেন হা.মে. সমশের আলী ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আব্দুর রহমান। তাছাড়া মাজেদ সাহেবের মামাতো ভাই সেলিম বিশ্বাস ও জামাতা শহিদুল্লাহ কামান্না যুদ্ধে শহীদ হন। সেদিনের সেই সম্মুখ যুদ্ধে মারা যান পারনান্দুয়ালী গ্রামের তাজুল ইসলাম। সেই সস্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন পারনান্দুয়ালী গ্রামের কমান্ডার আব্দুস সামাদ ও আব্দুল জলিল। ভাগ্যবশত তারা দুজনই বেঁচে যান। কিন্তু কমান্ডার সামাদ সেদিনের সেই সম্মুখযুদ্ধে মারাত্মক আহত হন, আজও তিনি সেই দুঃসহ যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ওই দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বৃদ্ধ ছামেনা বেগম জানান, তিনি একটি গর্তের ভেতর রবিশেঠ, জাহাঙ্গীরসহ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রেখে উপরে খড় বিছিয়ে লুকিয়ে রাখেন। পাকসেনারা চলে গেলে নদী পার করে নিরাপদে আলফাপুরের দিকে চলে যেতে সাহায্য করেন। যুদ্ধে আহত এক মুক্তিযোদ্ধাকে পানি খাওয়াতে গেলে বৃদ্ধ রঙ্গ বিবি ও ফণিভূষণ কুন্ডু নামের দুই গ্রামবাসীও নরঘাতকদের হত্যার শিকারে পরিণত হন। এছাড়াও হানাদারদের রাতভর বিক্ষিপ্ত এলোপাতাড়ি গুলিতে কয়েক গ্রামবাসী গুরুতর আহত হন।
পরদিন সকালে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে হাজার হাজার জনতা এসে ভিড় জমায় কামান্নার অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটিতে, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধার নিথর দেহগুলো। গ্রামবাসী সেসব মৃতদেহ এক স্থানে জড়ো করে। কিন্তু হানাদারদের পাল্টা আক্রমণের ভয়ে তড়িঘড়ি করে কামান্নার হাইস্কুলের খেলার মাঠের উত্তর পাশে কুমার নদের ধারে ৬ জন করে দুটি ও ৫ জন করে ৩টি গণকবরে ২৭ বীর সন্তানকে কবর দেন।
স্বাধীনতার ৩৮ বছরের মাথায় মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরগুলো ঘেষে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে গ্রামবাসী। মিনারের গায়ে লেখা আছে ২৭ শহীদের নাম। কামান্না যুদ্ধে নিহত ২৭ বীর শহীদ এর প্রতি ঝিনাইদহের চোখ’র পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।