জানা-অজানাটপ লিডদেখা-অদেখামহেশপুর

ঝিনাইদহ হালদারপাড়া যেন একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম

ঝিনাইদহের চোখ-
শত শত বছরেও শ্রীনাথপুরের হালদারপাড়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি। হালদারপাড়ার তিনপাশে ইছামতি নদী আর এক পাশে ভারত। আজো তারা নিজেদের তৈরী বাঁশের সাঁকোয় জীবনের ঝুকি নিয়ে প্রবেশ করে চলেছেন। চলাচলের যানবাহন সব রেখে যেতে হয় নদীর ওপারে। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের গ্রামটি এখনও যেন এক বিচ্ছিন্ন এলাকা।

ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আশরাফ উদ্দিন বলেন, হালদারপাড়ার বাসিন্দারা আস্তে আস্তে পাড়া ছেড়ে দিচ্ছেন। এক সময় ৬৫ টি পরিবার বসবাস করলেও বর্তমানে আছে মাত্র ২০ টি পরিবার।

সরেজমিনে শ্রীনাথপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় হালদারপাড়া থেকে কৃষি পন্য কাঁধে করে ইছামতি নদী পার করা হচ্ছে। তারা এভাবেই ফসল পারাপার করে থাকেন বলে জানান কয়েকজন। পাড়ার মধ্যে প্রবেশ করে দেখা যায় শুনশান নিরব পরিবেশ।

স্থানীয়রা জানালেন, এই পাড়ার পুরুষেরা একবার বাইরে কাজে বের হলে আর ফিরতে চান না। কাজ শেষে একেবারে সন্ধ্যায় বা রাতে ফেরেন। পাড়ার নারীরা ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই পাড়াটি থাকে নিস্তব্ধতায় ঢাকা।

অন্যপাড়ের পাড়ার বাসিন্দা মনোরঞ্জন হালদার (৭২) জানান, তার জন্ম এই পাড়াতেই। তাদের
পূর্ব পুরুষও এই পাড়ার বাসিন্দা। মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের একটি গ্রাম শ্রীনাথপুর। এটি ভারত সীমান্ত সংলঘ্ন একটি গ্রাম। এই গ্রামের দুইটি অংশ রয়েছে, একটি অংশে হালদাররা, আরেকটিতে অন্যরা। হালদারপাড়ায় ৬৫ টি পরিবার বসবাস করতেন, আর অপর অংশে ছিলেন ২৫০ টি পরিবার। শত শত বছর ধরে এই দুই এলাকায় জনবসতি রয়েছে। ভুমি অফিসের খাতায়ও শ্রীনাথপুর মৌজায় দুইটি ভাগে বিভক্ত। এক নম্বর সীটে হালদারপাড়া আর দুই নম্বরে বাকি অংশ।
হালদারদের অংশে ৩৫০ বিঘা জমি রয়েছে।

তিনি আরো জানান, তাদের গ্রামের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে রয়েছে ভারত থেকে বয়ে আসা ইছামতি নদী। তিনি পূর্ব পুরুষের কাছে শুনেছেন এই নদীতে মাছ ধারা পেশা থেকেই হালদারপাড়ায় হালদারদের বসবাস। তারা যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করছেন। বর্তমানে ২০ টি পরিবার বসবাস
করেন, যার মধ্যে ৬ টি পরিবার মুসলিম রয়েছে। এরা নানা সময় বিনিময় করে এখানে এসেছেন।

ওই পাড়ার বাসিন্দা সাধন হালদার জানান, তাদের মতো এতো কষ্ট করে পাড়ায় কেউ
বসবাস করে না। কিন্তু এই পাড়ার বাসিন্দারা সবাই আর্থিক ভাবে দূর্বল। যে কারনে তারা কষ্ট করে বসবাস করছেন। তিনি জানান, পায়ে হেটে তারা ভারত অভ্যন্তরে প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দেশে প্রবেশের ব্যবস্থা নেই। যেদিক যাওয়া হোক নদী পার হতে হবে। এই নদী ভারতীয় নদী হওয়ায় সারা বছরই কমবেশি পানি থাকে। যে কারনে তারা বেরুতে পারেন না। স্থানীয় ভাবে পাড়ার দক্ষিনে নদীর উপর বাঁশ দিয়ে সাঁকো তৈরী করে নিয়েছেন। মাত্র দুইটা বাঁশের উপর দিয়ে তাদের চলতে হয়।
পাড়ায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের এই বাঁশের উপর দিয়ে চলেই স্কুলে যেতে হয়।

পাড়ার বাসিন্দা অনিতা হালদার জানান, বিয়ে হয়ে এই পাড়ায় এসেছেন। এখন পর্যন্ত বাবার বাড়ি যাওয়া-আসা খালি হাতেই করতে হয়।

স্থানীয় নজরুল ইসলাম জানান, শখ করে মৃত্যুঞ্জয় হালদার একটি মটর সাইকেল কিনেছেন যা আজো বাড়ি নিতে পারেননি। নদীর ওপারে রেখে বাড়ি যেতে হয় তাদের। তিনি আরো জানান, মাঠে যে ফসল হয় তা বাঁধে করে নদী পার করতে হয়। বাড়িতে একটা ফার্নিচার তৈরী করে নেওয়া যায় না। সবাই যাযাবরের মতো বসবাস করেন। তাদের এই অবস্থার কারনে বাইরের কেউ এই পাড়াতে ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিতে চান না। এই কারনে অনেকে এই পাড়া থেকে চলে গেছেন। যারা আছেন তাদের যাবার সুযোগ না থাকায় পড়ে আছেন।

নজরুল ইসলাম আরো বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দপ্তরে তারা এই নদীর উপর দিয়ে চলাচলের মতো একটা সেতু বা বেইলী ব্রীজ এর দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজো কেউ এ
বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। ভোটের সময় যারা ভোট নিতে আসেন তারাও বাঁশ পেরিয়ে আসেন। সে সময় প্রতিশ্রতি দেন সেতু করার, কিন্তু পরেই ভুলে যান।

এ বিষয়ে শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের শ্রীনাথপুর এলাকার সদস্য হারুন-অর রশীদ জানান, তারা বেশ কয়েকবার এখানে একটা সেতুর জন্য প্রকল্প তৈরী করে উপজেলায় জমা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নয়ন কুমার রাজবংশী জানান, বিষয়টি তিনি অবগত নন। তবে এলাকার লোকজন তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে এবং বিস্তারিত তথ্য দিলে তিনি খোজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের উদ্যোগ নেবেন ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button