ঝিনাইদহে গরুর ডে-কেয়ার সেন্টার ।। উপকৃত কৃষক
ঝিনাইদহের চোখ-
দল বেঁধে ছুটে চলেছে গরুগুলো, নেওয়া হচ্ছে মাঠে। একেক দলে দুই থেকে তিন শত গরু আছে। যাওয়া-আসার সময় গোটা রাস্তায় গরুর ভীড়। পথচারীরা থমকে দাড়িয়ে পড়ছে, গরুগুলো পার হলে তাদের যাওয়া। তিন-চারটি দলভুক্ত হয়ে মাঠে ঘাষ খেতে নেওয়া হয় গরুগুলো। এদের মাঠে নেওয়ার জন্য রয়েছে রাখাল। যারা গোয়াল থেকে গরু নিয়ে সারাদিন চরানোর পর সন্ধ্যায় গোয়ালে তুলে দেন। মাসে প্রতিটি গরুর জন্য তারা পান ২ শত টাকা। দলে দলে বিভক্ত হয়ে মাঠে বেড়ালেও গরুগুলো দলছুট হয় না। এই গরুগুলো রাখালদের আপনজন।
ঝিনাইদহ মহেশপুর উপজেলার করিঞ্চা গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে দেশি জাতের গরু। এগুলো দিনের বেলায় লালন-পালন করেন নিদ্ধারিত রাখালগন। যারা মালিকের ঘর থেকে বেলা ১০ টায় মাঠে নিয়ে যান আবার সন্ধ্যায় গোয়ালে পৌছে দেন। এই পদ্ধতিতে গরু লালন করে অর্থ উপার্যন করছেন গরুর মালিকরা। গ্রামের মানুষ আয়ের পথ হিসেবে মাঠে কৃষি কাজের পরেই গরু পালন বেছে নিয়েছেন। মালিকদের ভাষায় এই পদ্ধতিতে গরু লালন-পালন করলে খরচ অনেক কম হয়।
সরকারি হিসাবেই এই করিঞ্জা গ্রামে ২ হাজার ৫ শত ৪০ টি গরু আছে। আর স্থানীয়দের ভাষায় গরুর সংখ্যা তিন হাজারের অধিক। গ্রামটিতে প্রায় ৪ শত পরিবারের বসবাস রয়েছে। যাদের প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে একের অধিক গরু। এমন অনেক পরিবারও রয়েছে যাদের ৪০ টির অধিক গরু আছে। গরুগুলো চরানোর জন্য গ্রামে ৬ জন রাখাল রয়েছে। এছাড়া কেউ কেউ নিজের গরু নিজেই মাঠে নিয়ে যান। সে ক্ষেত্রেও রাখালের দলের সঙ্গেই যান।
রবিবার করিঞ্চা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় গ্রামের পিচ রাস্তাটি জুড়ে গরু আর গরু। রাখাল ছাতা মাথায় দিয়ে গরুর দল নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন। ইদ্রিস আলী নামের একজন রাখাল জানান, তাদের দুইটি দলে প্রায় ৫ শত গরু রয়েছে। তাদের মতো আরো ৩ থেকে ৪ টি দল রয়েছে। যারা সবাই প্রতিদিন সকাল ১০ টায় গোয়াল থেকে গরু নিয়ে বের হন, আর সন্ধ্যা ৬ টায় বাড়ি ফেরেন। সারাদিন এগুলো মাঠে চরিয়ে নিয়ে বেড়ান।
করিঞ্চা এলাকার ইউপি সদস্য আসাদুল ইসলাম জানান, গ্রামের প্রতিটি পরিবারে গরু আছে। দেশি জাতের গরু লালন-পালন গ্রামের মানুষের একটি পেশা। বেশির ভাগ গরু রাখাল দিয়ে মাঠে চরানো হয়। রাখালের দায়িত্ব গরুর মালিকদের গোয়াল থেকে গরু নিয়ে সারাদিন চরানোর পর আবার গোয়ালে তুলে দেওয়া। এভাবে তারা গরু লালন-পালন করেন। তিনি জানান, মাঠে খাওয়ানো হলে গরুর মালিকদের গরু লালন-পালনে অনেক খরচ কম হয়। একটি দেশি জাতের গরু বাড়িতে রেখে পালতে গেলে প্রতিদিন ঘাষ, ভুষি, খৈল, চালের কুড়ো মিলিয়ে কমপক্ষে ২ শত ৫০ টাকা ব্যয় হয়। সেখানে মাঠে চরানো হলে ১ শত টাকা খরচ করলেই চলে। এক্ষত্রে ১ শত ৫০ টাকা ব্যয় কম হয়। তিনি আরো বলেন, অনেক গরুর মালিক নিজেরা তাদের গরু মাঠে নেন। রাখাল দিয়ে মাঠে গরু চরাতে মাসে গরু প্রতি ২ শত টাকা দিতে হয়। তিনি আরো জানান, গরু এই গ্রামের মানুষের আয়ের একটি অন্যতম উৎস্য হওয়ায় গোটা গ্রামে গরুগুলোর একপ্রকার রাজত্ব রয়েছে। মাঠে চরানোর সময় গরুর গলায় কোনো রশি থাকে না। গ্রামে ঘুরে ঘুরে খেয়ে বেড়ায় তারা। রাস্তায় দল বেঁধে চলার সময় সবাই তাদের পথ ছেড়ে দেন, কেউ গরুর গায়ে হাতও দেন না।
করিঞ্চা গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী জানান, তাদের গ্রামের চারিপাশে মাঠ। বিশেষ করে বিএডিসি’র ফার্ম রয়েছে। যেখানে ফসল কাটার পর অনেক ঘাষ পাওয়া যায়। এসব স্থানে মানুষ গরু চরিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, গাভিগুলো দুধ দেয়। কৃষকরা সারা বছর দুধ বিক্রি করেন। একটি দেশি জাতের গাভি ২ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত দুধ দেন। যার ৬০ টাকা কেজি দরে তারা বিক্রি করেন। গরু বড় করে লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। তার নিজের ৯ টি গরু আছে। যেগুলো রাখালের কাছে দিয়ে দেন। মাঠে খাওয়ানোর পর বাড়িতে অল্প খাবার দিলেই চলে।
ইদ্রিস আলী জানান, এই গরু চরিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। গরু প্রতি ২ শত টাকা করে পেয়ে তার মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হয়। তার মতো আরো বেশ কয়েকজন এই কাজের সঙ্গে জড়িত। আরেকজন আব্দুল হাকিম জানান, গরুগুলো তাদের খুব মান্য করে। যেভাবে তাদের চলতে বলা হয় সেভাবেই চলে। কখনও তারা দলের বাইরে যায় না। শামীম হোসেন জানান, মাঠে খাইয়ে গরু পালন করা খুবই সহজ। যা খোলা মাঠ না থাকায় অনেক স্থানে হয় না। আবার দল বেঁধে মাঠে নেওয়ার অভ্যাসও নেই।
এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মোঃ আতিবুর রহমান জানান, পাশ^বর্তী এলাকায় খোলা মাঠ থাকায় রাখাল দিয়ে মাঠে গরু চরিয়ে থাকেন করিঞ্চার কৃষকরা। এভাবে দেশি গরু লালন-পালন করলে কম খরচ হয়। যে কারনে করিঞ্চা গ্রামের মানুষ বেশি বেশি দেশি গরু লালন-পালন করেন। প্রাণী সম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকেও তারা সার্বক্ষনিক খোজ খবর রাখেন বলে জানান।