ঝিনাইদহের গর্ব সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুরের জন্মদিন আজ
ঝিনাইদহ চোখ-
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের মাঝে যে সাত জনের আত্মত্যাগ ও বীরত্বে জাতি তাঁদেরকে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে মরণোত্তর সম্মান দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। তিনি বীরশ্রেষ্ঠদের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।
আজ (২ ফেব্রুয়ারি) এ মহান বীরের শুভ জন্মদিন। ১৯৫৩ সালের এইদিনে তদানিন্তন যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খোর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম আক্কাস আলী ও মাতা কায়দাছুন নেছা। হামিদুর মা-বাবার প্রথম সন্তান। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় অতি শৈশব থেকেই বাস্তবতার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। শৈশবে খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করলেও উচ্চশিক্ষার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্রতা।
তবে সংগ্রামী হামিদুর পিছিয়ে থাকতে চাননি। তাই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী পদে যোগ দেন। ভর্তির পরই প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে পাঠানো হয়। ২৫ মার্চের রাতে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্থানীয় আরও কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টরে অংশ নেয়। সিপাহী হামিদুর রহমান নিজের সততা এবং একান্ত কর্তব্যনিষ্ঠা থেকেই যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। অংশগ্রহণ করেন একের পর এক যুদ্ধে।
১৯৭১ এর অক্টোবরে হামিদুর রহমান মুক্তিবাহিনীর সাহসী সদস্য হিসেবে ১ম ইস্টবেঙ্গলের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। ২৮ অক্টোবরে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০-এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হামিদুরসহ ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে।
তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুজন পাক সৈন্যের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ করে পোস্টটিকে অকার্যকর করতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হয়। কিন্তু হামিদুর রহমান সেই বিজয়ের স্বাদ স্বাদ গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি এর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তবে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হন তিনি। হামিদুর রহমানের আত্মত্যাগ রচনা করে আমাদের মুক্তির পথ।
ফাঁড়ি দখলের পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের মৃতদেহ উদ্ধার সীমান্তের অদূরে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় একপরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করেন। তবে কবরটি নীচু স্থানে অবস্থিত হওয়ায় এক সময় পানিতে তলিয়ে যায়। তাই ২০০৭ সালের ২৭শে অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছর ১০ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ পদক দেয়া হয় সিপাহী হামিদুর রহমানকে। এ মহান বীরের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৮ সালে শহীদের নিজগ্রাম খোর্দ্দ খালিশপুরের নাম পরিবর্তন করে ‘হামিদনগর’ করা হয় এবং হামিদনগরে প্রতিষ্ঠিত কলেজমাঠে নির্মাণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। এছাড়া তাঁর নিজ নামে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি ফেরিও তার নামে রাখা হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলা শহরের স্টেডিয়ামটি তাঁর নামে, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাঁর স্মরনে একটি ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে। ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) নাম পরিবর্তন করে হামিদুর রহমানের নামে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কেন্দ্রীয় মিলনায়তন নামকরণ করা হয়েছে।
নির্ভীক অকুতোভয় মহান বাঙালি, বীর সিপাহী হামিদুর রহমানের নাম এদেশের মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবে।